চিনি এবং খাদ্য শস্যের জন্য চটের বস্তার বাধ্যতামূলক ব্যবহার কমিয়ে দেবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, তার জেরেই দীপাবলির আগে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন রাজ্যের পাট চাষি, আড়তদার এবং ব্যবসায়ীরা। গত দশ দিনে রাজ্য জুড়ে পাটের দাম কমেছে হু হু করে। কেবল মঙ্গলবারেই কুইন্টালে দেড়শো থেকে সাড়ে পাঁচশো টাকা দাম কমেছে নানা জেলায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার পাট চাষিদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে।’’ তিনি সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান।
গত ৩১ অক্টোবর থেকে চিনির বস্তায় ৬০ শতাংশ, আর খাদ্য শস্যে ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে চটের বস্তার ব্যবহার। ফলে কলকাতার ‘জুট হাউসে’ পাটের দাম চার-পাঁচশ টাকা পড়ে গিয়েছে। দিন দশেক আগেও এক কুইন্টাল পাট আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার গোলাবাড়ির পাট ব্যবসায়ী গোলাম রসুল। মঙ্গলবার দাম কমে দাঁড়িয়েছে দু’হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে চাষিদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন গোলাম। তাঁর কথায়, “জুট হাউস আর মাল নিতে চাইছে না। আমি তো মরছিই। চাষিরাও মরবে। কালীপুজোর পরে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।”
চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট ম্যানুফ্যাকচার্রাস অ্যাসোসিয়েশনের (ইজমা) চেয়ারম্যান মণীশ পোদ্দার বলেন, “৩১ অক্টোবর কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক নির্দেশ বার করার দিন থেকেই চটের বস্তা ও কাঁচা পাটের দাম হু হু করে কমেছে। কোথায় থামবে, বলতে পারব না।”
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তিন কোটি মানুষ পাট চাষ এবং পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই রাজ্যই। বারাসতের দাদপুরের পাটচাষি গোলাম বিশ্বাস বলেন, “পাট বিক্রি করেই চাষিরা রবিশস্য বোনার আশায় রয়েছেন। সব্জিতে মার খাওয়ার পরে পাটে মার খেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
|
‘এ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি। পাট উৎপাদনে সর্ববৃহৎ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিহার ও অসমের চাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেন্দ্র এ ভাবে চাষিদের আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো ইউপিএ সরকারের এখনই চলে যাওয়ার
সময় এসেছে।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী |
|
নদিয়ার করিমপুরে দিন দশেক আগেও যখন ব্যবসায়ী ২০০০-২২০০ টাকা কুইন্টালে পাট বিক্রি করেছেন, এখন দাম পাচ্ছেন ১৫০০-১৬০০ টাকা। মুর্শিদাবাদে দু’হাজার টাকা থেকে ১৩০০ টাকায় নেমেছে। বর্ধমানের কালনাতে পাটের দাম কমেছে কুইন্টালে দু’শো থেকে তিনশো টাকা। একই চিত্র হুগলিতেও।
মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গে পাটের দাম গতকালের চাইতে কুইন্টাল প্রতি ৩০০ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭০০ টাকা। পাট চাষি তথা কৃষক সভার ময়নাগুড়ি ব্লক সম্পাদক নির্মল চৌধুরী বলেন, “প্রতিদিনই দাম কমছে। আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।” কোচবিহারের ধলপলের পাট চাষি সিদ্ধার্থ মণ্ডল বলেন, গত বছরের চাইতে চাষের খরচ বেড়েছে, কিন্তু কুইন্টালে দাম কমেছে ৫০০ টাকা। এমনিতেই গত দু’বছর ধরে সরকার উত্তর দিনাজপুরে পাট কিনছে না। তার উপরে দাম কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়বে, বলছেন চাষিরা।
রাজ্যে পাট বিক্রি কার্যত থমকে গিয়েছে। বেশির ভাগ ফড়ে ও আড়তদার পাট কিনছেন না। চাষির ঘরে ডাঁই হয়ে জমে রয়েছে পাট। ভিজে পাটের জল শুকিয়ে যেতে থাকায় ওজন কমছে। গুণমানও নষ্ট হচ্ছে। ফলে পরে দাম আরও পড়বে।
তবে বিপত্তির এমন ‘মাত্রা’ মানতে নারাজ জে সি আই (জুট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া)। জুট কমিশনার সুব্রত গুপ্ত বলেন, “ন্যূনতম নির্ধারিত মূল্য থেকে দাম পড়ে যাওয়ার খবর নেই। তবে সামান্য হলেও দাম কমেছে। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় এমন ঘটনা কী ভাবে ঘটছে তা খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।”
জাতীয় জুট বোর্ডের সদস্য ও কোচবিহারের পাটচাষি লালমোহন দাস এ দিন তুফানগঞ্জ থেকে বলেন, “এ রাজ্যে কোচবিহারেই সবচেয়ে উন্নত মানের পাট চাষ হয়। কিন্তু একে সারের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়া, তারপর সরকারের ন্যূনতম ক্রয়মূল্য না-বাড়া এবং শেষে এই ভাবে কাঁচা পাটের দাম পড়ে যাওয়ায় চাষি আর বাঁচবে না। উত্তরবঙ্গে পাটচাষিরা ঠিক করেছে, এ বার ভুট্টা চাষ করবে।”
চটের বস্তার চাইতে পলিথিনের বস্তার দাম প্রায় ১২ টাকা কম। তাই পলিথিনের বস্তায় চিনি সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। বারাসতের কদম্বগাছির পাট চাষি আব্দুর রহিমের কথায়, “সার, চাল, ডাল, সব্জি সবই পলিথিনের বস্তায় যাচ্ছে। চটের বস্তায় সরবরাহ হত কেবল চিনি। সেই রাস্তাও এমন ভাবে বন্ধ করলে কোথায় যাবেন চাষি? পাট চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। পাটকাঠি দিয়ে ঘরের ছাউনি ও জ্বালানির কাজ করেন গরিব চাষিরা। সে ব্যবস্থাও যাবে বন্ধ হয়ে।” |