কাপ আর ঠোঁটের ছোট্ট দূরত্বে টেস্ট ক্যাপ ফস্কে যাওয়া একজন ক্রিকেটারের জীবনের পরের দিনটা বর্ণনা করতে গেলে কোন শব্দগুলো ঘুরেফিরে আসবে? বিষাদ, হতাশা, রাগ, দুঃখ?
কিন্তু সেই ক্রিকেটারের নাম যদি হয় মনোজ তিওয়ারি, তা হলে এর কোনওটাই কাজে আসবে না। মঙ্গলবারের মনোজকে দেখে কে বলবে, এই ছেলেটা টেস্ট অভিষেকের স্টেশনে নামতে নামতেও হোঁচট খেয়েছে? বরং মনে হবে হ্যাঁ, এই ছেলেটাই পারবে। আজ হল না তো কী? এই গনগনে আত্মবিশ্বাস, এই চোয়াল শক্ত করা সংকল্প থেকে কত দিন মুখ ফিরিয়ে থাকবেন নির্বাচকরা?
টেস্ট টিমে ডাক না পাওয়ার পরের দিন কেমন কাটল মনোজের? আর পাঁচটা দিনের মতোই। ম্যাচে থাকলে বাড়ির কাজের সময় পান না, তাই আজ সারা দিন সেই নিয়েই ডুবে থাকলেন। সন্ধেবেলা বন্ধুর সঙ্গে একটু আড্ডা, আবার আড্ডার ফাঁকে কাজও। এখন না হয় নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার কিছুটা সময় পেয়েছেন। সোমবার খবরটা পাওয়ার পরে নিশ্চয়ই হতাশ হয়েছিলেন? “নাহ, ম্যাচের মধ্যে অত ভাবার সময় থাকে না। যখন খবরটা পেলাম তখন যদি একা বাড়িতে থাকতাম তা হলে খুব দুঃখ হত। তা ছাড়া ক্যাপ্টেন্সির চাপ থাকে সব সময়। কাল একটা সময় আমরা ওভারে পিছিয়ে পড়েছিলাম। কী ভাবে ম্যানেজ করা যায়, সেটা নিয়েই ভাবছিলাম,” যখন বলেন মনোজ, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না। ইনি তো আর বছর তিনেক আগের সেই আগ্নেয়গিরি নন। |
দল নির্বাচনের পরের সকাল। মঙ্গলবার বন্ধুর
অফিসে মনোজ। ছবি: উৎপল সরকার
|
এই মনোজ অনুপ্রেরণা খুঁজে নেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রত্যাবর্তনের লড়াই খুব কাছ থেকে দেখে, যুবরাজ সিংহের চোখের মরিয়া জেদে, অস্কার পিস্তোরিয়াসের মতো প্রতিবন্ধী অ্যাথলিটের কালজয়ী কাহিনি শুনে। টেস্ট দলে ডাক না পেলে এই মনোজ রাতের ঘুম নষ্ট করেন না। সুরেশ রায়নার মতো লাঞ্চ না খেয়ে নিজের রাগ উগরে দেন না। “খাবারের উপর রাগ দেখিয়ে কারও কোনও লাভ হয় বলুন? একটা সময় প্রচুর স্ট্রাগল করেছি। আজ যে এত ভাল ভাল রেস্তোরাঁয় খেতে যাই, আগে ভাবতেও পারতাম না। যা পাই, তাকে সম্মান করতে জানি। আমি কোনও দিন নিজের হতাশা খাবারের উপর বের করব না। কে জানে আজ খাবার নষ্ট করলে পরে কোনও দিন খেতে পাব কি না!”
মঙ্গলবারের মনোজ এই যে এত ঠান্ডা, জাতীয় দলে ব্রাত্য থেকেও এত নিস্পৃহ, তার পিছনে শুধু তাঁর নতুন জীবনদর্শন নয়, লুকিয়ে রয়েছে কঠিন ক্রিকেটীয় যুক্তিও। সেঞ্চুরি করেও টানা চোদ্দো ম্যাচের নির্বাসন তাঁকে শিখিয়েছে, স্কোয়াডে থেকে ম্যাচের পর ম্যাচ রিজার্ভ বেঞ্চ গরম করার চেয়ে দলে ডাক না পাওয়া ঢের ভাল। “যারা প্রথম এগারোয় থাকে, তারা নেটেও বেশি সময় পায়। আমাদের সুযোগ পেতে পেতে নেট বোলাররা এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে আমার আর ইচ্ছে করে না ছেলেগুলোকে আরও খাটাতে।” আরও আছে। “ম্যাচের দিন ড্রেসিংরুমে নিজের আবেগ একটুও না দেখিয়ে ফার্স্ট ইলেভেনের প্লেয়ারদের সঙ্গে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করাটা কি সহজ? আর পরিবর্ত হিসেবে যদি এক ওভারের জন্যও ফিল্ডিং করি, অসহ্য চাপ থাকে। ওই ছ’টা বলের মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে তো! তার চেয়ে এটা অনেক সহজ!”
এখন পাখির চোখ তাই পঞ্জাব ম্যাচ। মনোজ জানেন, তাঁর কাজ রান করে যাওয়া। পরিসংখ্যান কথা বলতে শুরু করলে নির্বাচকরা আর কত দিন চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন? যাঁর হাতে ব্যাট কথা বলে, তাঁর হাত থেকে কাপ আর কত বার ফস্কাবে? |