শুধু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশেষ সুযোগ পাবে, এটা রাজ্য সরকারের
নীতি নয়।
উচ্চশিক্ষার
সামগ্রিক নীতি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়কে
তো
একসঙ্গে
সমান সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এটাই বাস্তব। সুগত মারজিৎ |
সম্প্রতি অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী একটি চিঠিতে (১০-৯) এবং অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী একটি প্রবন্ধে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে (৩১-১০) কিছু অভিমত পেশ করেছেন। সেই সূত্রে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে কতকগুলো বিশেষ পদক্ষেপ সরকার করেছেন। সেই নীতি যেহেতু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না, তাতে হয়তো খানিকটা বঞ্চনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তার স্বপক্ষে অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছেন প্রেসিডেন্সি মেন্টর গ্রুপ থেকে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর পদত্যাগের কথা, যা নিঃসন্দেহে একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গে একেবারে বিশ্বমানের প্রথম সারির অধ্যাপকদের সংখ্যা খুবই কম। তাঁদের অন্যতম অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর পদত্যাগে নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্সি মেন্টর গ্রুপের সদস্যবৃন্দ এবং আমি অত্যন্ত মর্মাহত। কিন্তু সেই সঙ্গে কতকগুলো বিষয়ে কিছু অস্পষ্ট ধারণা স্বচ্ছ করা প্রয়োজন।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি অধ্যাপক সুশীল চৌধুরীর সঙ্গে সহমত যে, ভাল ছাত্রছাত্রী ছাড়া ভাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে না, এবং অনেক দিন অনেক ভাল ছাত্রছাত্রী পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে গিয়েছে সুনাম গড়ে উঠতে অনেক সময় লাগে, দুর্নাম কুড়োতে সময় লাগে না। অতীতের সেই পাপস্খালনে আত্মনিয়োগ করেছে এই সরকারের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা।
১) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বতন্ত্র ভাবে গড়ে তোলার সুযোগ না দিলে প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব জায়গাতেই কিছু প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সুনাম সর্বজনবিদিত, কিন্তু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে আজকের দুনিয়ায় প্রতিযোগিতায় সক্ষম উন্নত মানের প্রতিষ্ঠান করে তুলতে গেলে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ আবশ্যিক। মনে রাখতে হবে, রাজ্য সরকারের হাতে কোনও প্রতিষ্ঠানকে একেবারে নতুন করে গড়ে তোলার মতো সুযোগ কম। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই অতীতের সমস্যাভারে প্রতিষ্ঠানগুলি ন্যুব্জ। দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক ভাবে নির্দিষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং রাজনীতিকরণের দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাবে জর্জরিত ব্যবস্থার কিছুটা উন্নয়নই এক বড় সমস্যা। অন্তত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছুটা নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ এসেছে, যেখানে খানিকটা নতুন ভাবে শুরু করার চেষ্টা চলেছে। মুড়ি-মিছরির এক দরে অভ্যস্ত আমরা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় খানিকটা ব্যতিক্রমী হলে ক্ষতি নেই। |
দিগদর্শক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপ। |
২) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনের সামগ্রিক কাঠামো রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। অর্থাৎ, বেতন-স্কেলের কোনও ফারাক সেখানে নেই। রাজ্যের নিয়ম ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশিষ্ট অধ্যাপকদের (ডিস্টিংগুইশড প্রোফেসর) বেতন নির্ধারিত হয়েছে, যাঁরা ওই কাঠামোর মধ্যে কিছুটা বাড়তি বেতন পাবেন। যদিও সে-সব পদে এখনও নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হয়নি। প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নামে বিশিষ্ট অধ্যাপকদের পদ আছে। বেতন ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে সেই পদে নবনিযুক্ত অধ্যাপকদের বেতন কেমন হবে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালক সমিতি আলোচনা করে ঠিক করতে পারেন। সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে কে কোন স্তরে বেতন পাবেন, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যাপার। যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু বিভাগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত। এঁদের সুনাম অনুযায়ী এঁরা গবেষণার জন্য অনেক রসদ জোগাড় করতে পারেন এবং করে থাকেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আজকেই সেটা করে উঠতে পারবে না।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, একই বেতন-স্কেলের মধ্যে থেকে নবনিযুক্ত অধ্যাপকদের বেতন স্তরের হেরফের ঘটিয়ে এবং তার সঙ্গে কিছু বাড়তি সুযোগসুবিধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সর্বোচ্চ পরিচালক সমিতিতে যদি তাদের প্রথম সারির বিভাগগুলির জন্য বিশেষ অধ্যাপক আনে এবং বেতনকাঠামোর মধ্যেই স্তরের হেরফের ঘটিয়ে তাঁদের জন্য নতুন কিছু করতে চায়, সরকার নিশ্চয়ই সেই প্রস্তাব বিবেচনা করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের সব ক’টি বিভাগকে উচ্চ গুণমানসম্পন্ন বলতে পারে না। আমার মতে দীর্ঘকাল অনীহা ও দুর্নীতির জন্য, খুবই কম বিভাগ সেই সামর্থ্য রাখে। রাজ্য সরকার কখনওই বলেনি যে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে না, কিন্তু গুণমানের শর্তটি সেখানে হওয়া উচিত নিরঙ্কুশ।
৩) পশ্চিমবঙ্গের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং প্রত্যন্ত জায়গার ছাত্রছাত্রীদের সমাজে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শিক্ষাজনিত সুযোগসুবিধা দেওয়া বর্তমান সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ কথা সত্যি যে, শুধু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন হলেই পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন হবে না, সেই কারণেই নতুন আইন হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালন সংক্রান্ত রীতিনীতির আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে, অধ্যাপক নিয়োগ প্রক্রিয়া অভূতপূর্ব ভাবে স্বচ্ছ এবং নিয়মানুবর্তী হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে গবেষণার জন্য অনেক বেশি কেন্দ্রীয় ও বেসরকারি অনুদান নিয়ে আসা যায়, উপাচার্যরা সবাই সেই বিষয়ে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছেন, অধ্যাপকদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন এবং তাতে বিশেষ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বেতনস্তর মোটামুটি ভদ্রস্থ এবং চেষ্টা করলে গবেষণার জন্য রসদের সূত্র অনেক, কিন্তু চেষ্টা করাটা বাঞ্ছনীয়। আজ যাঁরা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ পদে আসছেন, তাঁদেরও ভবিষ্যতে চেষ্টা করেই রসদ জোগাড় করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য দশ বছর আগেও টাকাকড়ি জোগাড় করা শক্ত ছিল, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অনুযায়ী রসদের ব্যবস্থা হয়। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সুনাম’ অনুযায়ী এখুনি রসদ পাওয়া শক্ত, কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বই আগে ছিল না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি জানি যে, প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোথাও এমনও হয়েছে যে, উপাচার্য প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে বিদেশভ্রমণ করেছেন, অথচ শিক্ষকেরা গবেষণা-সম্মেলনে যোগদানের রসদ পাননি। কী ভাবে সেই রসদের আয়তন বৃদ্ধি ও বণ্টন সুষ্ঠু ভাবে হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক সমিতিগুলোকে সে দিকে নজর রাখতে হবে। কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই অনেক নিয়োগ হয়েছে, অনেক নয়-ছয় হয়েছে। আজ সে বিষয়ে অনুসন্ধান হচ্ছে, কার্যকর ব্যবস্থার চেষ্টা হচ্ছে। সেই অপচয়জনিত অর্থের সদ্ব্যবহার হলে পড়াশোনায়, গবেষণায় খরচা করার অনেক রসদ থাকত। সে দিকেও নজর রাখা বাঞ্ছনীয় ছিল।
৪) পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকাতার কাছে ও দূরে কিছু অধ্যাপক নিশ্চয়ই আছেন, যাঁদের গুণমানের তুলনা নেই। তেমন অধ্যাপক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, বা তার চেয়ে উন্নত মানের অধ্যাপক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, মেন্টর গ্রুপ নিশ্চয়ই সেটা চাইছেন। সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে এখনও এ রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় ভাল পড়ানো হয়, ভাল গবেষণা হয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেই প্রচেষ্টা খানিকটা বিক্ষিপ্ত। উচ্চ গুণমানের শিক্ষক নিয়েই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার কথা। মেন্টর গ্রুপ ও রাজ্য সরকার সেই চেষ্টাই করছে।
রাজ্যের সমধিক উন্নতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো এবং অধ্যাপকদের গুণমান, সব দেখেই ছাত্রছাত্রীরা রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। অবশ্যই আর একটি বিশেষ শর্ত হল, স্কুল-কলেজে কেমন পড়াশুনো হচ্ছে, তার গুণমান। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণমান বাড়ে কী করে? পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের অধ্যাপকদের বড় অভাব। তার কারণ খুঁজতে গিয়ে শুধু রসদের অভাবের দিকে আঙুল তুললে চলবে কি? এমন বিভাগও দেখা যায়, যেখানে প্রায় সব অধ্যাপকই সেই বিভাগেরই ছাত্রছাত্রী, কিংবা বিজ্ঞানের এমন কোনও বিভাগ, যেখানে গবেষণার জন্য অধ্যাপকেরা নিয়মিত ভাবে গবেষণা প্রকল্পের প্রস্তাব দেন না। এই সমস্যার নিয়ন্ত্রণও জরুরি। এই সব সমস্যা তিল থেকে তাল হলেও কিন্তু প্রতিবাদের ঝড় ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন সমিতিতে সেখানকার মেধাবী অধ্যাপকদের জন্য বিশেষ আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার প্রস্তাব নিয়ে আজ পর্যন্ত কত বার আলোচনা হয়েছে? ক’টা প্রস্তাব সরকারের কাছে এসেছে? তা ছাড়া, এই রাজ্যের দু’টি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ষড়যন্ত্র করে মেধাবী তরুণ অধ্যাপকদের পূর্ণ অধ্যাপক পদ বা নামাঙ্কিত বিশিষ্ট অধ্যাপক পদে বসানো হয়নি এগুলো প্রমাণ সংবলিত সত্য। ক’টা প্রতিবাদ হয়েছে? প্রশ্নটা কিন্তু ভাবা দরকার।
|
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য উচ্চ শিক্ষা সংসদের সভাপতি। মতামত ব্যক্তিগত। |