খবর না পেয়ে অশান্তির মুখে পড়া, এক কথা। অশান্তির সম্ভাবনা রয়েছে বলে গোয়েন্দা দফতর বারবার সতর্ক করলেও দুবরাজপুরের লোবায় গণ্ডগোলে জড়িয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বীরভূম জেলা পুলিশ। অভিযানে গিয়ে আহত একাধিক পুলিশকর্মী মেনে নিয়েছেন, “এ রকম হামলা হবে বলে আমরা তৈরি ছিলাম না।” গোয়েন্দা দফতরের সতর্কবার্তা থাকলেও এই অভিযানের প্রয়োজন হল কেন? জবাব দিতে গিয়ে খোদ জেলা পুলিশ হৃষিকেশ মিনা, “বারবার চাপ আসছিল” বলে মন্তব্য করায় চড়েছে বিতর্কের পারদ। পুলিশ-প্রশাসনের কিছু কর্তার অনুমান, এই বিতর্কের সূত্রেই আপাতত ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ওই পুলিশ সুপারকে।
গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে লোবায় আটক রয়েছে ডিভিসি-এমটার যন্ত্র। ওই রাতেই সেই যন্ত্র ছাড়াতে গিয়ে এক বার ব্যর্থ হয় পুলিশ। তারপর থেকে যন্ত্রটি ঘিরে চলছে গ্রামবাসীর নিরন্তর পাহারা। জেলা গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, বারবার প্রশাসনিক হস্তক্ষেপেও পরিস্থিতি না বদলানোয় নিয়মিত নজর রাখা হচ্ছিল লোবার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির উপরে। রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তার কথায়, “প্রায় এক বছর ধরে যে ভাবে লোবায় আন্দোলনটা চলছে, দেখে আমাদের মনে হয়েছিল ওখানে নতুন করে পুলিশ পাঠিয়ে কিছু করার চেষ্টা হলে বিপদের ঝুঁকি আছে। গত কয়েক মাস ধরে জেলা পুলিশের কর্তাদের কিন্তু সে ব্যাপারে বারবার সতর্ক করা হয়েছে।” |
বর্ধমান থেকে অজয় এবং হিংলো নদী পেরিয়ে বহু দুষ্কৃতী বিভিন্ন সময়ে লোবা এলাকায় ঢোকে-বেরোয় বলে খবর রয়েছে পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কাছে। পাশাপাশি, জেলা আবগারি দফতর এবং নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর (পূর্বাঞ্চল) দাবি, বীরভূম জেলায় গত কয়েক বছরে যে সব এলাকায় অবৈধ পোস্ত-চাষের খবর মিলেছে লোবা অঞ্চল ছিল তাদের প্রথম সারিতে। এ বছরও ওই এলাকা থেকে প্রচুর পোস্তর আঠা উদ্ধার হয়েছে। একাধিক জনের নামে পুলিশে অভিযোগও হয়েছে। এখনও ওই এলাকায় অবৈধ পোস্ত কারবারীদের আসা-যাওয়া রয়েছে। সেই সূত্র ধরেই জেলা গোয়েন্দা দফতরের দাবি, লোবা এলাকায় অবৈধ অস্ত্র থাকার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। তাই জমি আন্দোলনের বিপক্ষে ওই এলাকায় গিয়ে আটক যন্ত্র ছাড়াতে গেলে ‘প্রতিরোধের’ মুখে পড়তে হতে পারে পুলিশকে।
জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তা বলেন, “সোমবার জেলা পুলিশ আমাদের জানায়, যন্ত্র ছাড়াতে লোবায় অভিযান করা হবে। ওই দিনই এ ব্যাপারে দু’টো বৈঠক হয়। তাতে আমরা ফের ওই এলাকায় অভিযান চালাতে নিষেধ করেছিলাম।”
তা হলে এমন অভিযানে পুলিশ গেল কেন, যেখানে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে ২৬-২৭ জন পুলিশকর্মী জখম হলেন, ভাঙচুর হল পুলিশের ৯টি ভ্যান?
ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) বাসব তালুকদার বলেন, “জেলা পুলিশ অভিযান চালাবে বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। পরে তা আমাদের জানানো হয়।” জেলার পুলিশ সুপার হৃষিকেশবাবু বলেন, “অনেকদিন থেকেই ওখানে জরুরি যন্ত্রপাতি পড়েছিল। সেগুলো উদ্ধারের জন্য আমাদের উপরে বারবার চাপ আসছিল। তাই আমরা অভিযান চালিয়ে ওই যন্ত্রপাতি উদ্ধারে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় দেড়শো পুলিশের বাহিনী ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় বেশি থাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।”
যন্ত্র আনতে কারা চাপ সৃষ্টি করছিল, তা ভেঙে বলেননি পুলিশ সুপার। বীরভূম জেলা সিপিএম অবশ্য এই ‘চাপ’-এর পিছনে শাসক দলের উস্কানি ছিল বলে অভিযোগ করেছে। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব।
জেলা গোয়েন্দা দফতরের সতর্কবার্তা থাকলেও পুলিশ কি উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়েছিল? এসপি বলছেন, “অশান্তি হতে পারে বলে খবর ছিল, এ কথা ঠিক। আমরা দেড়শো পুলিশকর্মী নিয়ে যাওয়াটাই যথেষ্ট বলে মনে করেছিলাম।” তবে জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে জখম হয়ে বর্ধমানে চিকিৎসাধীন বীরভূমের তিন পুলিশকর্মীর বক্তব্য, “বলা হয়েছিল, রুটিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে হবে। তির- বোমার মুখে পড়তে হবে ভাবিনি। আক্রমণের মুখেও দাঁড়াতে পারিনি।” নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বীরভূম জেলা পুলিশের একাধিক কর্মীর বক্তব্য, “একটা মাটি কাটার যন্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে যে ভাবে পুলিশের মুখ পুড়ল, তাতে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিলে কিছু করার থাকবে না!” |