|
|
|
|
জমিযুদ্ধে গুলি নয়া জমানায় |
খনির যন্ত্র উদ্ধারে গিয়ে আক্রান্ত পুলিশ |
দয়াল সেনগুপ্ত • দুবরাজপুর |
খনির জন্য মাটি কাটার একটি যন্ত্র সরাতে গিয়ে খণ্ডযুদ্ধ বাধল পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে। অভিযোগ উঠেছে পুলিশের গুলিচালনারও। গুলিতে আহত হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্র। যদিও পুলিশ গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনাকে ছুটিতে পাঠিয়ে তদন্ত শুরু করেছে রাজ্য প্রশাসন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পর জমির আন্দোলনকে ঘিরে এটি অন্যতম তীব্র সংঘর্ষ গ্রামবাসী ও পুলিশের মধ্যে। মঙ্গলবার ভোরে বীরভূমের দুবরাজপুরে এই সংঘর্ষে দু’পক্ষের ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। রাজ্য প্রশাসনের বক্তব্য, এদের মধ্যে ছ’জন গ্রামবাসী। দু’জনের আঘাত গুরুতর। এক পুলিশকর্মীর মাথা ফুঁড়ে দেয় গ্রামবাসীর ছোড়া তির। ইটের ঘায়ে জখম হ’ন বেশ কিছু পুলিশকর্মী। পুলিশের লাঠির ঘায়েও মাথা ফাটে অনেকের। ভাঙচুর হয় পুলিশের ৯টি ভ্যান, পুলিশের সঙ্গে থাকা ক্রেন আর ট্রেলারে। |
|
তিরবিদ্ধ পুলিশ সুবিমল হাজরা, সিউড়ি হাসপাতালে |
কিন্তু সব চেয়ে গুরুতর অভিযোগ, গ্রামবাসীকে লক্ষ করে এ দিন গুলি ছোড়ে পুলিশ। পুলিশের ছোড়া গুলিতে এক মহিলা-সহ চার গ্রামবাসী জখম হলেন বলেও অভিযোগ উঠল। পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা অবশ্য বলেন, “প্রায় ১৫০ জনের পুলিশ বাহিনী ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল। তারা পুলিশের উপর যথেচ্ছ তির, বোমা, ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। বাধ্য হয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও স্টান গ্রেনেড (যেগুলিতে ভীষণ আওয়াজ ও আলো হয়) ছোড়া হয়।”
আনন্দবাজারের প্রতিবেদক কিন্তু ঘটনাস্থল ঘুরে গুলি ও কার্তুজের খোল দেখতে পেয়েছেন। এই ধরনের কার্তুজ (৫.৫.৬ এমএম) সাধারণত ইনস্যাস রাইফেলে ব্যবহার হয় বলে পুলিশ সূত্রের খবর। আর গুলিটি .৯ এমএম পিস্তলের। গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, মাওবাদী উপদ্রুত হিসাবে ঘোষণার পরে বীরভূমের একাধিক থানায় ইনস্যাস পাঠানো হয়েছে। ইনস্যাসের মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি পুলিশ ছাড়া আর কার কাছে থাকতে পারে?
এ দিন আদালতের নির্দেশ নিয়ে পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে কয়েকশো পুলিশকর্মী কয়লা তোলার যন্ত্রটি গ্রামবাসীর দখল থেকে ছাড়াতে গেলে নিমেষে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। জেলা সিপিএম নেতৃত্বও পুলিশের গুলি চালানোর অভিযোগ করেছেন। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অরুণ মিত্র বলেন, “ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়ে বুধবার থেকে বামফ্রন্ট আন্দোলনে নামবে।” |
এই যন্ত্র উদ্ধারেই পুলিশি অভিযান |
হাসপাতালের পথে |
|
রাজ্য সরকার গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মুখ খোলেননি, আসেনি তাঁর ফেসবুক-বার্তাও। তবে মহাকরণে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, পুলিশের তরফে যথেষ্ট ধৈর্য দেখানো হয়েছে। পুলিশ সুপার তাঁকে জানিয়েছেন, আহতদের কারও গায়ে গুলি লেগেছে, এমন প্রমাণ নেই। সন্ধ্যায় অবশ্য এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ জানান, ‘‘বীরভূমের পুলিশ সুপারকে ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে। জেলার দায়িত্ব নেবেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (ডিডি, স্পেশ্যাল) মুরলীধর। প্রশাসনিক তদন্তের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা এখনও ঠিক হয়নি।”
যন্ত্র নিয়ে যন্ত্রণার সূত্রপাত দুবরাজপুরের লোবা পঞ্চায়েত এলাকায় ডিভিসি-এমটা কোল মাইনস লিমিটেডের ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ ভিত্তিতে কয়লা তোলার প্রকল্পের সূচনা থেকে। প্রায় ৩৩০০ একর জমির মধ্যে ৭০০ একর কিনতে পেরেছে এমটা সংস্থা। কিন্তু গ্রামবাসীদের একটি বড় অংশ জমি দিতে অনিচ্ছুক, বা ক্ষতিপূরণের অঙ্কে অখুশি। প্রতিরোধের মুখে পড়ে কাজ থমকে যায়। কয়লা খননের একটি যন্ত্র আটক করে রাখেন গ্রামবাসীরা। তার পাশে গত ১১ মাস ধরে ধর্না মঞ্চ থেকে পাহারা চলছিল গ্রামবাসীর। |
|
|
বিধ্বস্ত পুলিশ ভ্যান ও কাটা রাস্তা। |
|
জমি নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে চলে-আসা সমস্যার জট কাটাতে গত ১৬ জুলাই লোবায় গিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ডিভিসি এবং এমটার কাছে কয়েক দিনের মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছিলেন। মঙ্গলবার দুবরাজপুরের ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পার্থবাবু বলেন, “তিন মাস আগে রিপোর্ট চাইলেও এখনও তা হাতে পাইনি।”
লোবা পঞ্চায়েত এলাকা এক সময়ে সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি ছিল। বাম জমানাতেই ওই পঞ্চায়েত এলাকায় খোলামুখ কয়লা খনি করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবস্থা বদলায়। টসে জিতে সিপিআই সদস্যকে প্রধান করে বোর্ড গড়ে তৃণমূল। তৃণমূলও খনি প্রকল্পকে সমর্থন করে। কিন্তু সরাসরি জমি কেনার পদ্ধতিকে ঘিরে স্থানীয় মানুষ ও কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। লোবা অঞ্চলে হিংলো নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে মাটি ফেলে রাস্তা বানানোর অভিযোগও ওঠে। এ সবেরই প্রতিবাদে গত বছর ১৯ ডিসেম্বর ডিভিসি-এমটার মাটি কাটার যন্ত্রটিকে আটক করেন করেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা ও কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যেরা। গ্রামবাসীরা জানান, প্রতিদিন ১০-১২ জন পালা করে ধর্নামঞ্চে থেকে যন্ত্রটিকে পাহারা দেন। সোমবার রাতে ধর্নামঞ্চে ছিল জোপলাই হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র জীবন বাগদি। আহত জীবন বলে, “ভোর ৫টা নাগাদ দেখি সারি দিয়ে গাড়ি ঢুকছে গ্রামে। পুলিশ নেমেই বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা ছুটে আসে।” |
দুবরাজপুরে দক্ষযজ্ঞ |
• ভোর ৫টা। লোবায় ঢুকল পুলিশ
• ট্রেলার, ক্রেন-সহ ৩৭টি গাড়ির কনভয়। পুলিশ সুপার, ৯টি থানার ওসি-সহ ১৫০ পুলিশ। ছিলেন এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট
• ঢুকেই ধর্নামঞ্চে গ্রামবাসীদের বেদম মার
• খবর পেয়ে ছুটে এলেন বাকিরা
• জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ। কাঁদানে গ্যাস, স্টান গ্রেনেড বনাম ইট, তির, বোমা। ৯টি পুলিশ ভ্যান-সহ ভাঙচুর ১২টি গাড়ি
• পুলিশকর্মীর মাথায় ফুঁড়ল তির। গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশের গুলিতে আহত ৪। অস্বীকার পুলিশের।
• পিছু হটল পুলিশ। যন্ত্র রইল গ্রামবাসীদেরই দখলে। |
|
প্রকল্প এক নজরে |
• অংশীদার: রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ডিভিসি এবং বেসরকারি বেঙ্গল এমটা কোল মাইনস লিমিটেড।
• পোশাকি নাম: খাগড়া-জয়দেব ক্যাপটিভ কোল প্রজেক্ট।
• উদ্দেশ্য: ডিভিসি-র দুর্গাপুর এবং মেজিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহ।
• জমি লাগবে: ৩,৩৫৩ একর। (২,২৩২ একরে খনি, বাকি পুনর্বাসন ও অন্য কাজে)
• কেনা হয়েছে: প্রায় ৭০০ একর।
• সমস্যা: জমি কেনার ‘পদ্ধতি’তে আপত্তি তুলে গত ডিসেম্বর থেকে ডিভিসি-এমটার মাটি কাটার যন্ত্র আটকে রেখেছে কৃষিজমি রক্ষা কমিটি। খনির কাজ এগোয়নি। |
|
প্রাথমিক ভাবে পুলিশ পিছু হটলেও পরে গুলি চালায় বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। তাঁদের দাবি, লাঠির বাড়ি ও গুলিতে আহত হন এক মহিলা-সহ অন্তত ১০ জন। গ্রামে ঢোকার একটি পাকা রাস্তাও কেটে দেন গ্রামবাসীরা। পুলিশের সঙ্গে কিছু বহিরাগত ছিল বলেও গ্রামবাসীদের দাবি। ডান পায়ের পাতা থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল বছর তিরিশের বধূ পূর্ণিমা ডোমের। তাঁর কথায়, “বাড়ির সবাই ছুটে ধর্নামঞ্চে গেল। আমিও ওদের পিছনে ছিলাম। পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল। একটা গুলি এসে লাগল পায়ের নীচে।” বাবুপুর গ্রামের বাসিন্দা, সক্রিয় আন্দোলনকারী গৌতম ঘোষের বাঁ পায়ে ক্ষত। তিনি বলেন, “অনেক রাউন্ড গুলি চলেছে। একটা আমার পায়ে লাগল।” সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানান, এক্স-রে-তে কিছু মেলেনি। বাইরে থেকে ক্ষতচিহ্ন দেখে, তা গুলির কি না, বলা সম্ভব নয়। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ফেলারাম মণ্ডল বলেন, “সব গুলি মাঠের ধানের তলায় চাপা পড়েছে। ধান উঠলেই পাওয়া যাবে।”
‘খাগড়া-জয়দেব ক্যাপটিভ কোল প্রজেক্ট’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট আর আর কিশোর বলেন, “ঘটনার পিছনে এলাকার কিছু লোকের দুষ্কৃতীমূলক মনোভাব রয়েছে।”
|
ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়াল সেনগুপ্ত |
|
|
|
|
|