|
|
|
|
মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প |
জেলায় হস্টেল নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
কোনও স্কুলে ভাঙাচোরা মাটির বাড়িতে মাথা গুঁজে রয়েছেন ছাত্রীরা। বহু দরবার করেও নতুন হস্টেল নির্মাণের অর্থ মেলেনি। আবার কোনও স্কুল না চাইতেই পাচ্ছে একাধিক খাত থেকে হস্টেল নির্মাণের টাকা! অথচ আদৌ এত ছাত্রী আছে কি না, থাকলেও তাঁদের খাওয়া-খরচ সরকার দেবে কি না এ সব প্রশ্নের জবাব নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত বিশেষ প্রকল্পে স্কুলের হস্টেল বানাতে গিয়ে এমনই অঘটন ঘটছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে প্রায় ১ বছর হতে চলল, এখনও দ্বিতীয় দফায় বরাদ্দ ৫০টি স্কুলের একটিতেও হস্টেল তৈরির কাজ শুরু হয়নি। প্রশাসন সূত্রে খবর, মাত্র ৪টি হস্টেলের ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দেওয়া হয়েছে। গোটা বিষয়ে প্রশাসনিক কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
এখন হস্টেল তৈরির জন্য একাধিক প্রকল্প রয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকশন প্ল্যান (আইএপি), মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরের অর্থ। চলতি বছরের শুরুতে জেলায় এসে মুখ্যমন্ত্রী পর্যাপ্ত হস্টেল তৈরির আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপরেই মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পে প্রথমে ১৭টি হস্টেল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় ধাপে আরও ৫০টি (সব ক’টিই ছাত্রীদের জন্য)। দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও স্কুল একাধিক খাতে হস্টেল নির্মাণের জন্য টাকা পেয়েছে। আবার কোনও কোনও স্কুল অনেক আবেদন-নিবেদনের পরেও হস্টেল তৈরির টাকা পায়নি।
ঝাড়গ্রামের একতাল ডিএম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে ১২৫ জন তফসিলি ছাত্রছাত্রীকে নিখরচায় ছাত্রাবাসে থাকার অনুমতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু থাকবে কোথায়? ছাত্রাবাস বলতে পুরনো দিনের মাটির ভাঙাচোরা বাড়ি। সমস্যা জানিয়ে বারবার জেলা প্রশাসনকে আবেদন করেছেন স্কুলের প্রধানশিক্ষক শুভাশিস চক্রবর্তী। কিন্তু মঞ্জুর হয়নি! মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের কোনও ধাপেই এই স্কুলের নাম নেই। প্রধানশিক্ষকের কথায়, “ভাঙাচোরা মাটির বাড়িতে ছাত্রীদের খুবই কষ্ট হয়। বিগত বাম সরকারের আমল থেকেই বারবার হস্টেল তৈরির জন্য আবেদন জানিয়ে এসেছি। এখনও তা মঞ্জুর হয়নি।”
নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যালয়। আইএপি থেকে হস্টেল নির্মাণে অর্থ পেয়েছিল এই স্কুল। মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের প্রথম ধাপেও টাকা পায়। ওই দু’টি খাতে দু’টি হস্টেল তৈরি হয়ে গিয়েছে। তারপরেও বিশেষ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে তৃতীয় বারের জন্য এই স্কুলে হস্টেল নির্মামে টাকা বরাদ্দ হয়েছে। একই ভাবে চাঁদড়া ও গুড়গুড়িপাল হাইস্কুলও আইএপি থেকে হস্টেল তৈরির টাকা পেয়েছিল। সেই কাজ শেষ হতে না হতেই আবার মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ছাত্রীদের জন্য হস্টেল নির্মাণের অর্থ পেয়েছে এই দু’টি স্কুল।
অথচ, একতাল ডিএম উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মতোই বঞ্চিত থেকেছে ভাদুতলা হাইস্কুল। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরী বলেন, “দু’বছর আগে ছাত্রদের জন্য একটি হস্টেল পেয়েছিলাম। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে বহু ছাত্রী আসে। ছাত্রীদের জন্য একটি হস্টেল নির্মাণের জন্য বারবার আবেদন জানিয়েছি, কিন্তু মেলেনি। অথচ, প্রয়োজন নেই এমন অনেক স্কুল কী ভাবে হস্টেল পেয়ে গেল বুঝতে পারছি না।”
পাশাপাশি দ্বিতীয় ধারে বরাদ্দ ছাত্রী হস্টেলগুলি কী ভাবে চলবে, নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্কুল-কর্তৃপক্ষের মতে, প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলিতে যে তফসিলি ছাত্রছাত্রীদের হস্টেল রয়েছে, তা সরকারি খরচে চলে। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের অনুমতিও লাগে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার হস্টেল নির্মাণের অর্থ দিলেও সেখানে কোন ধরনের ছাত্রীদের রাখতে হবে, তাদের খাওয়া খরচ কে দেবে, এ বিষয়ে কোনও নির্দেশিকা নেই। চাঁদড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু সামন্ত বলেন, “আমি মৌখিক ভাবে দু’একবার জানিয়েছিলাম, ছাত্রীদের জন্য একটি হস্টেল হলে ভাল হয়। তার জন্য অর্থ মঞ্জুর হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কী ভাবে ছাত্রীদের রাখা হবে, খাবারের খরচ কে দেবে, তা নিয়ে সরকারি নির্দেশিকা না আসায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।” একই বক্তব্য গুড়গুড়িপাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌতম ভৌমিকের। তাঁর কথায়, “প্রশাসন যেমন নির্দেশ দেবে, তেমন ভাবেই হস্টেল চালানো হবে।”
প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রত্যন্ত এলাকায় গরিব মানুষের বাস বেশি। তাঁদের অধিকাংশেরই মেয়েকে হস্টেলে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য নেই। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ স্কুলেই হস্টেলের প্রয়োজনীয়তা কম। তফসিলিদের জন্য সরকার নিখরচায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে বলেই হস্টেলগুলি চলে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের দ্বিতীয় দফায় যে হস্টেলের অনুমোদন রয়েছে, সেখানে কেবল পরিকাঠামো তৈরির খরচ দিচ্ছে সরকার। ছাত্রীদের থাকতে হলে নিজেদের খরচ দিয়ে থাকতে হবে। এই সমস্যা হল কেন?
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, তালিকা তৈরির আগে ঠিক ভাবে খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষও সরকারি খরচে একটি সম্পদ তৈরি হবে বলে মত দিয়েছেন। ভবিষ্যতে প্রকল্পটি আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি না ভাবেননি। ফলে আর পাঁচটা প্রকল্পের মতো সরকারি জটে আটকে গিয়েছে হস্টেল তৈরির প্রক্রিয়া। |
|
|
|
|
|