|
|
|
|
স্বস্তির ৩ পয়েন্টেও বিষাদের ছায়া |
ব্রাত্য মনোজদের ঘিরে বাংলা ক্রিকেটে বিস্ফোরণ |
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
রঞ্জি চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের দিনে বিষাদও মিশে থাকল বাংলা ক্রিকেটে।
ঋদ্ধিমান সাহার (৬৫ নট আউট) চোয়ালচাপা যুদ্ধ, বাংলা ড্রেসিংরুমে তিন পয়েন্ট ঢুকে পড়া, দিনের শেষে সবই ব্যাকফুটে। বরং সোমবার মাঝদুপুরের পর বাংলার ক্রিকেট-আকাশে শুধুই দুই বঙ্গজ নক্ষত্র এবং ভারতীয় দলে তাঁদের উপেক্ষার কাহিনি। রাজস্থানকে ঘায়েল করলে কী হবে, ইংল্যান্ড টেস্টে মনোজ-দিন্দার তো জায়গা হল না!
দুপুর দেড়টা নাগাদ বাংলা ড্রেসিংরুমে যখন ইন্ডিয়ার টিম লিস্ট পৌঁছয়, মনোজরা তখন ফিল্ডিং করছেন। খবরটা প্রথম জানতে পারেন অশোক দিন্দা। কিছুক্ষণের জন্য ড্রেসিরুমে ঢুকেছিলেন, আর ঢুকতে না ঢুকতেই দুঃসংবাদ। শুনে স্তব্ধ হয়ে যান বাংলা পেসার। স্বগোতোক্তি করে ফেলেন, “আমি নেই! রাখল না আমাকে!” সামান্য সামলে একটু পর ফিরে যান মাঠে। ক্যাপ্টেন মনোজকে ডেকে বলেন, “জানিস, আমাদের কারওরই হয়নি।”
সব শুনেও শান্ত ছিলেন মনোজ। কিন্তু দিন্দা এতটাই ভেঙে পড়েন যে, বাংলা টিম ম্যানেজমেন্টকে জানিয়ে দেন বল করার মতো মানসিক অবস্থায় আর নেই। দরকারও পড়েনি। রাজস্থানের দ্বিতীয় ইনিংস চললেও ম্যাচ ততক্ষণে ‘মৃত’। হৃষিকেশ কানিতকরদের সামনে জয়ের জন্য ৩৩০ রানের টার্গেট ছুড়ে দেওয়ার পরই ম্যাচের ভবিষ্যৎ-লিপি পরিষ্কার হয়ে যায়: দু’সেশনে রাজস্থানের দশ উইকেট তুলে ছ’পয়েন্টের কিস্তিমাত সম্ভব নয়। তিন নিশ্চিত। খুব বেশি হলে বাকি সময়ে কিছু স্ফুলিঙ্গ বেরোতে পারে। স্পিডোমিটারের কাঁটা দেড়শোয় তুলে দিন্দার রাজস্থান ওপেনারের স্টাম্প ছিটকে দেওয়া, ‘কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়’ থিওরি মেনে মনোজ তিওয়ারির পুরো পয়েন্টের জন্য ঝাঁপানো, আক্রমণাত্মক ফিল্ড প্লেসিং, লক্ষ্মীরতন শুক্লের সুইংয়ের বিষে জোড়া উইকেটসবই এক-একটা স্ফুলিঙ্গের নমুনা। যা দাবানল হয়ে উঠল না স্রেফ সময়ের অভাবে।
আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ খুলল বরং অন্য জায়গায়। যার নাম বঙ্গ-ক্রিকেটমহল। প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক থেকে মনোজ-দিন্দার সতীর্থবিভিন্ন মহলে দুপুরের পর থেকে বিক্ষোভের লাভাস্রোত। কেউ বলছেন, ন্যক্কারজনক নির্বাচন। কারও চোখে ধরা পড়ছে দল বাছাইয়ের নামে রাজনীতি। সঙ্গে প্রশ্ন, কী ভাবে পনেরো জনের দলে থাকে চার ওপেনার? কোন যুক্তিতে মনোজকে বাদ দিয়ে নেওয়া হয় মুরলী বিজয়কে? ইশান্ত শর্মা কী এমন করেছেন যে অশোক দিন্দাকে বাইরে বসে থাকতে হবে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও বলে দিয়েছেন, “মনোজের চেয়ে যোগ্য কেউ নেই। ওর যা ক্ষমতা, কিছু দিন আটকে রাখা যাবে হয়তো। কিন্তু বেশি দিন নয়।”
|
‘নো দিন্দা, নো মনোজ—পূর্বাঞ্চল থেকে কি আদৌ কোনও নির্বাচকের দরকার আছে?’ |
ভারতের হয়ে ওয়ানডেতে |
মনোজের ব্যাটে |
দিন্দার বলে |
২০১২ |
২০১২ |
• ম্যাচ ২ ইনিংস ২ রান ৮ গড় ৪৩ সর্বোচ্চ ৬৫ হাফসেঞ্চুরি ১ |
• ম্যাচ ৫ উইকেট ৬ সেরা ২-৪৭ গড় ৪০.৬৬ |
গত রঞ্জিতে মনোজ |
গত রঞ্জিতে দিন্দা |
• ৪ ম্যাচে ৫৯৫ রান, সর্বোচ্চ ২৬৭, গড় ১৪৮.৭৫। |
• ৬ ম্যাচে ৩৭ উইকেট, সেরা বোলিং ৭-৪৪। |
• দলীপে গত দু’বছরে দিন্দা: ৫ ম্যাচে ৩১ উইকেট, সেরা বোলিং ৮-১২৩।
|
• চলতি মরসুমে ইশান্ত শর্মা: দলীপ ২ ম্যাচে ৪ উইকেট, সেরা বোলিং ৪-২৬। ইরানিতে ১ ম্যাচে ৩ উইকেট, সেরা বোলিং ২-১৭। রঞ্জিতে ১ ম্যাচে ৩ উইকেট, সেরা বোলিং ২-৮৮। |
|
ক্রিকেটমহলের ক্ষোভের আগুন ছুঁতে পারছে না মনোজকে। হাসছেন, পরিচিতদের সঙ্গে ইয়ার্কি-ঠাট্টা চালাচ্ছেন অক্লান্ত ভাবে। পঞ্জাব ম্যাচের দল নির্বাচনে বসছেন নিশ্চিন্ত মেজাজে। অবাস্তব মনে হচ্ছে? কিন্তু এই মনোজ নিজের আবেগ সামলাতে শিখেছেন। নইলে আর ড্রেসিংরমের সামনের লনে দাঁড়িয়ে বলবেন কেন, “তিন বছর আগের মনোজ হলে মাথা গরম করত। উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলত। কিন্তু আমার কাছে এ তো নতুন নয়। সেঞ্চুরি করেও চোদ্দোটা ম্যাচ বসে থেকেছি।” যদি ইডেন টেস্টে ডাক আসে? দল নির্বাচন তো হয়েছে দু’টো টেস্টের। শুনে আবার একগাল হাসি এবং উত্তর, “ওরে বাবা, তা হলে তো ড্রিম কাম ট্রু!” কিন্তু হাসিখুশি মুখেও তো দুঃখের চোরাস্রোত মিশে থাকল যখন বললেন, “ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওই ইনিংসটার পর প্রত্যাশা খুব বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হল না।” দিন্দা এত কিছু বলার অবস্থায় ছিলেন না। সন্ধেয় মন-খারাপের ইডেন ছেড়ে বেরনোর সময় শুধু বলে গেলেন, “প্লিজ, আজ নয়। আজ আমাকে ছেড়ে দিন।”
চূড়ান্ত অবিচারের এই ছবিটাই সহ্য হচ্ছে না কারও।
কয়েকশো মাইল দূরে দুই ভৌগলিক অবস্থানে হাজির ছিলেন দুই প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক। ইডেনে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চণ্ডীগড়ে প্রণব রায়। নির্বাচনের নমুনা দেখে সম্বরণের ঝাঁঝালো রায়, “ঘরোয়া ক্রিকেটটা তুলে চেন্নাই-লাইনটাই এখন নেওয়া ভাল। জন্মে শুনিনি এক টিমে চারটে ওপেনার। পারফরম্যান্স ছাড়াই মুরলী, ইশান্ত আছে। আর পারফর্ম করেও মনোজ-দিন্দা নেই!” পঞ্জাব থেকে ফোনে প্রণবের গলা আবার নির্লিপ্ত শোনায়। “বছরের পর বছর একই জিনিস চলছে। পারফর্ম করা-টরা এখন সব মুখের কথা। নির্বাচনী টেবিলে অন্য ব্যাপার হয়। মনোজ সেঞ্চুরি করছে, বড় রান করছে। আর কী করতে পারে ওরা?” দেশের মাটিতে চার পেসার খেলানো সম্ভব নয় বলে দিন্দা নেই, তবু ক্রিকেটমহল মানছে। কিন্তু মনোজ কেন নেই, কারও বোধগম্য হচ্ছে না। “বিদেশ হলে পাঁচ পেসার থাকত। দিন্দাও ঢুকে যেত। ওর ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মনোজকে মিডল অর্ডারে রাখা যায় না?” প্রশ্ন তুলছেন রণদেব বসু। প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার দেবাঙ্গ গাঁধীর কথায়, “মনোজকে চোখ বুজে দলে রাখা উচিত ছিল। সবচেয়ে বড় কথা ও ফর্মে আছে।” মনোজদের আর এক সতীর্থ ঋদ্ধিমান সাহাও পুরো ঘটনাচক্রে আশ্চর্য, “বুঝে পাচ্ছি না কী ভাবে দু’জনেই বাদ পড়ল!” নির্বাচনী বৈঠকে পূর্বাঞ্চল নির্বাচক সাবা করিম কতটা সক্রিয় ছিলেন, তা নিয়েও কথা হচ্ছে। সৌরভ ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিচ্ছেন সাবাকে। বলছেন, “প্রথম বৈঠক। আরও সময় ওর দরকার। কিন্তু সিএবি-কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে।” আর বাংলার নির্বাচক প্রধান দীপ দাশগুপ্তের উত্তর, “সাবার কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল। ঠিক আছে। দেখা যাক।”
আর প্রত্যাবর্তনের টোটকা?
সৌরভ নিজের উদাহরণ টানছেন। নিজের ক্রিকেটজীবনের চড়াই-উতরাইয়ের প্রসঙ্গ টেনে মনোজকে তাঁর পরামশর্র্: মাঠের বাইরের জগৎ ভুলে, বাইশ গজের দুনিয়ায় নতুন করে তাকাও। দীপ জানেন, এই ধাক্কাটা আরও তাতিয়ে দেবে দিন্দাকে। ক্যাপ্টেন তিওয়ারিকেও। কখনওই চূর্ণ করে দেবে না। মনোজও জানেন, পারবেন। “আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। মাঝে বেশ কয়েকটা রঞ্জি পাচ্ছি, হাতে ব্যাট আছে...দেখি না।” তাঁর চাউনি, ঠান্ডা অথচ কঠিন সংকল্প দেখলে মনে হয়, বর্তমানের যন্ত্রণাও তাঁর কাছে অতীত। চোখ আটকে শুধু ভবিষ্যতের দিগন্তে।
এই না হলে মনোজ তিওয়ারি!
|
সংক্ষিপ্ত স্কোর |
বাংলা ২৫৮ ও ২৩২-৯ ডি: (ঋদ্ধি ৬৫ ন:আ:, লক্ষ্মী ৩২)
রাজস্থান ১৬১ ও ১৮১-৩ (কানিতকর ন:আ: ৮০, লক্ষ্মী ২-২০)। |
|
|
|
|
|
|