তাঁর কোনও আমরা-ওরা ছিল না। আশ্চর্য নমনীয়তা ছিল তাঁর মুখে।
সদ্য প্রয়াত শান্তিগোপালের কথা মনে করিয়ে দিলেন
গৌতম চক্রবর্তী |
মেক আপের সামান্য অদলবদলেই তিনি কখনও হিটলার, কখনও বা লেনিন। কখনও হো চি মিন, কখনও আবার মঞ্চে ঘোষণা করেন, ‘আমি সুভাষ।’ এই মরসুমে তিনি নেপোলিয়ন, পরের মরসুমেই ‘বিদ্রোহী বিবেকানন্দ।’
অভিনেতা বিভিন্ন চরিত্রে রূপ দেবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু শান্তিগোপাল শুধু অভিনেতা নন। ষাটের দশকের যাত্রাতেও চার দিক খোলা মঞ্চে অভিনেতা মাইক্রোফোন ছাড়া চেঁচাতেন, পিছনে এক দল বসে ক্ল্যারিয়নেট, বেহালা বাজাতেন। শান্তিগোপালের পরিচালনায় ১৯৬৮ সালে তরুণ অপেরার ‘হিটলার’-এ ব্যবহৃত হল মাইক্রোফোন। টেপ রেকর্ডারে শোনানো হল আহত মানুষের চিৎকার, মেশিনগানের আওয়াজ। ৫০০ ওয়াটের ফ্লাডলাইটে কখনও লাল, কখনও সবুজ ফিল্টার। শিল্পের আধুনিকীকরণে কখনও পিছিয়ে থাকেননি শান্তিগোপাল। তরুণ অপেরার আগে তিনি চিৎপুরের নট্ট কোম্পানিতে ছিলেন। ‘ওদের পুরনো ঢঙের অভিনয়ধারা মানতে পারিনি। শুধু চেঁচালে অভিনয় হয় না’, পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। নট্ট কোম্পানি অবশ্য পরে ইতিহাস তৈরি করে। ১৯৭৫ সালে তারা নামায় ‘মা মাটি মানুষ।’
১৯৩৪ সালে বাগবাজারের এক বনেদি পরিবারে জন্মেছিলেন শান্তিরাম পাল। ঠাকুর্দা দেবেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন বিচারপতি। শান্তিরামের অভিনয় জীবন শুরু গ্রুপ থিয়েটারে। অমর ঘোষের ‘উদয়াচল’ দলে। ‘শেক্সপিয়র পড়েছি, গণনাট্য আন্দোলন দেখেছি। ফলে যাত্রা যে কোন অসুখে ভুগছে, বুঝতে দেরি হয়নি,’ তিনি বলেছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের শান্তিরামই হয়ে উঠবেন যাত্রার শান্তিগোপাল!
এবং তরুণ অপেরার প্রথম পালা ‘হিটলার’ নামবে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের তীর্থস্থান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর মঞ্চে। যাত্রা বনাম থিয়েটারেও তখন আমরা-ওরা নেই। সত্তরের দশকে ‘কার্ল মার্ক্স’ পালা শুরুর আগে এক আসরে বোমা পড়েছিল। সেখানে মার্ক্সের ভূমিকায় অভিনয় করতেন শান্তিগোপাল। পরের দিনই উৎপল দত্ত থেকে স্বপনকুমার, সকলে সেই ‘মস্তানি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ওয়ান্স অ্যান অ্যাক্টর অলওয়েজ অ্যান অ্যাক্টর। যাত্রা না সিনেমা না রেডিয়ো, দেখার দরকার নেই। গ্রুপ ডি কর্মচারী না গেজেটেড অফিসার, তা-ও অবান্তর ছিল।
|
শান্তিগোপাল পাল
(১৯৩৪-২০১২) |
সেই সমাজে রাজনীতিও অন্য রকম। হরেকৃষ্ণ কোঙার ‘লেনিন’ দেখতে এসে শান্তিগোপালকে জড়িয়ে ধরছেন, ‘আমাদের দুশোটা বক্তৃতায় যা হয় না, আপনার একটা নাটকে এক দিনে তা হয়।’ কৃষক সম্মেলনে বৃষ্টিতে ভিজে শান্তিগোপালের যাত্রা দেখছেন জ্যোতি বসু। কিন্তু পালাকার সরাসরি রাজনীতিতে নেই। নেই মন্ত্রী বা উপদেষ্টার চেয়ারে। শান্তিগোপাল বলেছিলেন, ‘কোনও পার্টির প্রচার আমাদের লক্ষ্য ছিল না। মানুষকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, একনায়কতন্ত্রের বিপদ নিয়ে সতর্ক করতে চেয়েছি, দেশপ্রেম জাগাতে চেয়েছি।’ এখন অবশ্য পার্টিই সত্য, কারণ তাহা সবর্শক্তিমান। পরিবর্তনের পরই ‘অগ্নিকন্যা মমতা’, ‘বাংলার মা মমতা’ ইত্যাদি নামের পালা তৈরির পরিকল্পনা নেয় চিৎপুর।
১৯৮৮ সালে তরুণ অপেরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন শান্তিগোপাল। দলের কর্মীরাই তাঁকে পথে বসিয়েছে গোছের অনুযোগ বারংবার করেছেন তিনি। নায়েক, সহঅভিনেতা, কর্মীদের প্রতি অভিমান ছিল, অভিমান ছিল বাঙালি জাতির প্রতি। ‘আমার মৃত্যুর পর ইতিহাস হয়ে থাকব। জীবদ্দশায় যাঁরা আমার কোনও খোঁজ নেননি, আমার মৃত্যুর পর তাঁরাই আমার বাড়িতে এসে আমার সম্পর্কে জানতে চাইবেন। যাত্রা করি বলেই আমাকে এত বঞ্চনা আর উপেক্ষা সইতে হল,’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। বাঙালির অবশ্য কিছু করার ছিল না। শীতের রাতে যাত্রা দেখার বদলে তত দিনে গ্রামগঞ্জেও ঢুকে গিয়েছে স্যাটেলাইট চ্যানেল, ডিভিডি প্লেয়ার।
শান্তিগোপাল যখন যাত্রার মঞ্চে সমতল পাটাতনের বদলে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত রোস্ট্রাম, মাইক্রোফোন, আলো ব্যবহার করছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিকৃতির অভিযোগ উঠেছিল। তিনি ছিলেন অনড়, ‘তামাম দুনিয়া কোট-প্যান্টলুন পরে ঘুরবে, আর যাত্রা বুঝি বিদ্যাসাগরের পোশাকে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকবে?’ আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তির ব্যবহার, নেতৃত্বের ক্ষমতায় ভর করেই যাত্রার মঞ্চে তিনি এনেছিলেন পরিবর্তন।
শান্তিগোপালকে আমরা কেন মনে রাখব? তাঁর আগে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ চরিত্রে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন ব্র্যান্ড। স্বপনকুমার মাইকেল মধুসূদন করে মাতিয়ে দিয়েছিলেন যাত্রাজগৎ। কিন্তু তাঁরা ওই একটি মুখেই আবদ্ধ ছিলেন। তার বাইরে বেরোতে চাননি। বা আজ নেপোলিয়ন, কাল কার্ল মার্ক্স, পরশু হোচিমিন সাজার নমনীয়তা তাঁদের মুখে ছিল না।
দর্শকসমাজও তখন নমনীয়। ১৯৬৯ সালে লেনিন নাটকের জন্য সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। সত্তরের দশকে তরুণ অপেরার বিজ্ঞাপনে লেখা হত ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শান্তিগোপাল।’ তখন আন্তর্জাতিকতা মানে শুধুই সোভিয়েত। কিন্তু বাঙালি দর্শক এবং নাট্যসমাজ তাঁকে মার্ক্স থেকে বিবেকানন্দ, সব মুখেই গ্রহণ করেছে। তাঁর ‘কমিউনিস্টত্ব’ আছে না ‘কংগ্রেসত্ব’ সেই কূট প্রশ্ন তোলেনি। এখন দিন আলাদা। পালাকার নিজেই ‘সি পি এমত্ব’ বনাম ‘তৃণমূলত্ব’ নিয়ে অ্যাকাডেমির সামনে হুঙ্কার দেন।
এই অসহনীয় পরিস্থিতিতেই চলে গেলেন শান্তিগোপাল। শেষ মঞ্চে নেমেছিলেন ২০১০ সালে। নিজের দল নান্দীকারের ‘জনশত্রু’ নাটকে।
এটা যদি তাঁর যুগ হত, তা হলে হয়তো মেক-আপের সামান্য এ দিক-ও দিকে এই মরসুমে তিনিই হয়ে উঠতেন কখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কখনও মরসুমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিগোপালের নমনীয়তা দর্শককে বুঝিয়ে দিত, শেষ অবধি কোনও তফাত নেই। দুটি মুখই এক!
মুখেরা আর একাকার হবে না। |