প্রবন্ধ ১...
শহুরে মধ্যবিত্তর লাভ, ছোট কৃষকের বিপদ
খুচরো ব্যবসায় বিনিয়োগ নিয়ে ইদানীং রাজনৈতিক চাপান-উতোর যতটা চলছে, অর্থনৈতিক আলোচনা ততটা
হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতাদের একটা লাইন ধরে নিয়ে সরলরেখায় কথা বলতে হয়। জটিল যুক্তির অবতারণা করে শ্রোতাদের গুলিয়ে দেবার ঝুঁকি তাঁরা নিতে পারেন না। তাই আমরা শুনতে পাচ্ছি, এক দল রাজনীতিক দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলছেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে দেশটা স্বর্গ হয়ে যাবে। আবার, তাঁদের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা বিদেশি বিনিয়োগ-এর কোনও সুবিধাই দেখতে পাচ্ছেন না। সম্ভবত, এই দুই মেরুর মধ্যবর্তী কোনও একটা জায়গায় আসল সত্যটা লুকিয়ে আছে।
আমাদের দেশে বেশ কিছু দিন ধরেই দেশি বৃহৎ পুঁজি খুচরো ব্যবসায় ঢুকেছে। প্রথমেই জানা দরকার, খুচরো ব্যবসার নিরিখে দেশি বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে বহুজাতিক পুঁজির তফাতগুলো ঠিক কোথায়। বহুজাতিক পুঁজি এলে কী কী ঘটতে পারে, যা দেশি বৃহৎ পুঁজির উপস্থিতিতে ঘটেনি? বস্তুত, বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীরা এলে আমরা তিনটে পরিবর্তন আশা করতে পারি উন্নততর প্রযুক্তি, মুক্ততর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বাজারে বহুজাতিকদের সর্বগ্রাসী, বিকটাকার উপস্থিতি।
ডাকছে বাজার। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি এলে শহুরে ক্রেতার হাতে পৌঁছে যাবে গোটা দুনিয়ার পণ্য।
প্রথমত, টেসকো, ওয়ালমার্টের মতো দৈত্যাকার খুচরো ব্যবসায়ীরা ভারতে এলে তারা সঙ্গে নিয়ে আসবে জামাকাপড়, খাদ্যশস্য, শাকসবজি বা ফলমূল মজুত করার আধুনিকতম প্রযুক্তি। এই উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বণ্টন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটবে, হিমঘরের অভাবে যে বিপুল পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়, তা ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যাবে। এই প্রযুক্তি দেশি পুঁজিপতিদের হাতে নেই। দ্বিতীয়ত, এই বিপণিগুলির মাধ্যমে দেশের উৎপাদনকারীরা যেমন সারা পৃথিবীর ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে পেয়ে যাবে, তেমনই আমাদের দেশের ভোক্তারাও সারা পৃথিবীর পণ্যসামগ্রী ভোগ করতে পারবে। অর্থাৎ, এই বহুজাতিক বিপণিদের মধ্যবর্তিতায় আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দেশি পুঁজিপতিদের সেই পরিকাঠামো, যোগাযোগ-যন্ত্র বা নেটওয়ার্ক নেই, যা দিয়ে তাঁরা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসা করতে পারেন। তৃতীয়ত, একটি বহুজাতিক বিপণি দেশি পুঁজিপতিদের অনেক গুণ মূলধন নিয়ে বিপুল ভাবে বাজারে নামবে। এক বার তারা বাজারে ঢুকে পড়লে, অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ছোট ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা শক্ত হবে।
বলে রাখা ভাল, দেশি বৃহৎ পুঁজিকে বাদ দিয়ে কোনও বহুজাতিক এ দেশে ব্যবসা করতে পারবে না। দেশি বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে তাদের যাতে যৌথ ভাবে ব্যবসা করতে হয়, সরকার সেই ব্যবস্থাই করেছে। ব্যবসায় বহুজাতিকের অংশ হবে সর্বাধিক ৫১ শতাংশ, বাকিটা দেশি পুঁজির। তাই বহুজাতিকের সঙ্গে দেশি পুঁজির বিরোধ থাকছে না, বরং বহুজাতিকের প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে নিজেদের লাভ বাড়িয়ে নিতে পারবে ভেবে দেশি পুঁজি খুচরো ব্যবসায় বহুজাতিক পুঁজিকে স্বাগত জানাচ্ছে।
আর পাঁচটা আর্থিক নীতির মতো খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগনীতিও কারও ভাল করবে, কারও কারও মন্দ। নতুন প্রযুক্তি এলে অপচয় বন্ধ হয়ে খাদ্যের জোগান বাড়বে, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে আখেরে, অর্থাৎ অতি দীর্ঘমেয়াদে, সম্ভবত সকলেরই ভাল হবে। কিন্তু পরিবর্তনের যে-দীর্ঘ রাস্তাটা ধরে নতুন ব্যবস্থায় পৌঁছতে হবে, সেটি যদি কারও কারও পক্ষে, বিশেষ করে গরিব মানুষের পক্ষে অতিশয় কণ্টকপূর্ণ হয়, তা হলে সে দিকটাও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন।
বহুজাতিকদের মাধ্যমে মজুত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে গ্রামের বাজারে শস্য, শাকসবজি এবং ফলমূলের দাম দুই ভাবে বাড়তে পারে। মজুতের অভাবে যে-মরসুমি আলু-পটল-ঢ্যাঁড়স-বেগুন গ্রামের বাজারে জলের দরে বিক্রি হত কিংবা পচে নষ্ট হত, সে সব এখন হিমঘরে জমা হয়ে এক সময় শহরে কিংবা ভিন দেশে পাড়ি দিতে পারবে। ফলে কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়বে, দামও বাড়বে। একই সঙ্গে, যে অল্পসংখ্যক বৃহৎ আড়তদার গ্রামের বাজারগুলোকে এত দিন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন এবং তাঁদের একচেটিয়া শক্তির বলে কম দামে কৃষকের পণ্য কিনছিলেন, বহুজাতিকরা এসে পড়লে গ্রামের বাজারে ক্রেতা হিসেবে তাঁদের একচেটিয়া আধিপত্য আর থাকবে না। অর্থাৎ, বড় ক্রেতাদের মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার আবহাওয়া তৈরি হবে এবং এই কারণেও বিক্রেতারা, অর্থাৎ কৃষকরা বেশি দাম পাবেন। দাম বাড়লে চাষির লাভ, আর চাষির লাভ বাড়লে সে তার জমিতে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত হবে। ফলে কৃষির উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা দুই-ই বাড়বে।

কিন্তু, গ্রামের বাজারে কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে সেই সব কৃষকেরই লাভ, যাঁরা তাঁদের পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে অধিকাংশ কৃষকই ভূমিহীন কিংবা প্রান্তিক। তাঁদের জমি নেই কিংবা জমির পরিমাণ এতই কম যে তার উৎপাদনে সারা বছর পেট চলে না, পরের জমিতে কাজ করে সেই উপার্জনে বাজার থেকে চাল-ডাল-শাকসবজি কিনে এদের খেতে হয়। খাবারের দাম বাড়লে এই গরিব মানুষগুলো ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বেন। কেউ কেউ বলছেন, কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাবে কৃষির মজুরিও বাড়তে বাধ্য। এটা সেই উপরতলার বৈভব চুঁইয়ে নীচে নামার তত্ত্ব। এটা নিজের থেকে সত্যি-সত্যি ঘটে কি না আমরা জানি না। এ ক্ষেত্রে কৃষি আরও লাভজনক হলে হয়তো কৃষিশ্রমের চাহিদা ও মজুরি এক দিন বাড়বে। কিন্তু কত দিনে?
আর একটা আশঙ্কা, কৃষিপণ্যের খুচরো বাজারে বহুজাতিকরা ঢুকলে যে অসংখ্য ছোট ছোট ব্যাপারি হাটে-বাজারে সবজি, চাল-ডাল বিক্রি করেন, তাঁদের অন্ন মারা যাবে। এ আশঙ্কা দু’ভাবে সত্যি হতে পারে। যদি বহুজাতিকরা ভারতের গ্রাম থেকে কেনা কৃষিপণ্য মূলত ভারতেই বিক্রি করে, তা হলে ছোট ব্যাপারিরা সরাসরি বহুজাতিকদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে; আবার বহুজাতিকরা মূলত বিদেশে রফতানির জন্য পণ্য কিনলে দেশি বাজারে তারা ততটা বিক্রি করবে না বটে, কিন্তু গ্রামের বাজার থেকে তারা অনেকটা পণ্য কিনে নেবে, তাই ছোট ব্যাপারিদের হাতে শহরে-গঞ্জে বিক্রি করার মতো খুব বেশি পণ্য পড়ে থাকবে না। ফলে ছোট ব্যাপারিরা আবার মার খাবে।
নতুন প্রযুক্তির সুফল নেওয়ার দরকার নেই, তা বলছি না। কিন্তু বহুজাতিক এলে গ্রামের গরিব মানুষ, যাঁদের বাজার থেকে কিনে খেতে হয়, তাঁরা বিপদে পড়বেন। ছোট ব্যাপারি বিপদে পড়বেন। যত দিন না মজুরি বাড়ছে, তত দিন ছোট চাষিদেরই বা কী করে চলবে?
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে যখন ব্যাপক ভাবে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হল, তখন বেশ কিছু দিনের জন্য যে সেখানে শ্রমের চাহিদা কমে গিয়েছিল। এর ফলে দীর্ঘ দিন, ঐতিহাসিক এরিক হব্সবম্-এর মতে প্রায় একশো-দেড়শো বছর, ইংল্যান্ডে শ্রমের প্রকৃত মজুরি তেমন একটা বাড়েনি। ডিকেন্সের উপন্যাসে, কার্ল মার্কস-এর ইতিহাসচেতনায় এবং আরও পরে চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে এই দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক শ্রেণির ছবি বার বার ফিরে এসেছে। আবার, শিল্পবিপ্লবের দেড়শো বছরের মধ্যে একটু একটু করে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক চেহারা আমূল বদলে গিয়েছিল। শ্রমিকদের হালও। শিল্পবিপ্লব না ঘটলে এই অকল্পনীয় উন্নতি সম্ভব হত না। (শ্রমিক শ্রেণির এই উন্নতি মার্কস দেখে গেলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর নৈতিক সংশয় হয়তো খানিকটা কাটত।) শিল্পবিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, শিল্পবিপ্লব ও যন্ত্রায়ণের ফল আখেরে সকলের পক্ষে ভাল হলেও নতুন ব্যবস্থায় পৌঁছনোর পথটা দরিদ্রের পক্ষে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সেই আদি যন্ত্রায়ণের সঙ্গে আমাদের বর্তমান অবস্থার মিল স্পষ্ট।
পরিবর্তনের কঠিন ভার কেন সর্বদা গরিব মানুষকেই বহন করতে হয়, এই নৈতিক প্রশ্ন তো আছেই। তা ছাড়াও, বর্তমানে যে-গণতন্ত্র আমাদের দেশে রয়েছে, শিল্পবিপ্লবের সময় ইংল্যান্ডে তার অভাব ছিল। ফলে পরিবর্তনের গুরুভার তখন যে ভাবে গরিব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গিয়েছিল, এখানে এখন আর সেটা সম্ভব নয়। তাই আমরা বলতে চাই, যে সরকার খুচরো ব্যবসায় বহুজাতিকদের নিয়ে আসছেন, তাঁরাই যেন গ্রামের গরিবদের জন্য কিছু রক্ষাকবচের কথা ভাবেন। নইলে অন্যায় হবে তো বটেই, উপরন্তু জনরোষের ফলে তাঁদের নীতিটাই অচল হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

শিল্প উৎপাদনে আমরা চিন বা অন্য কয়েকটি এশীয় দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আপাতত এঁটে উঠতে পারব বলে মনে হয় না। ধরে নেওয়া যায়, বহুজাতিকদের মাধ্যমে দেশে মুক্ততর বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে চিনে পোশাক, খেলনা, ছুরি-কাঁচি-হাতা-খুন্তি-কাঁটা-চামচ বা ছোটখাটো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে আমাদের বাজার ভরে যাবে। বেশ কিছু দিন যাবৎ চিনের বৃহত্তম বাণিজ্যসঙ্গী কোনও দেশ নয়, ওয়ালমার্ট নামক দৈত্যাকার বিপণন সংস্থাটি। চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হলে দেশের অনেক ছোট ছোট কলকারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কমে যেতে পারে কর্মসংস্থান।
চিনে শ্রমিকদের কোনও অধিকার নেই, শ্রম-আইনগুলি সবই মালিকের পক্ষে। সেখানে শ্রমিকদের দিয়ে প্রায় যত খুশি কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। প্রতিযোগিতাটা যেহেতু অসম, তাই বহুজাতিকদের মাধ্যমে শিল্পদ্রব্য আমদানির ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা দরকার।
অন্য দিকে, বহুজাতিকরা অবাধে দেশের বাজার থেকে কৃষিপণ্য কিনে বিশ্ব বাজারে বিক্রি শুরু করলে দেশে কৃষিপণ্য, বিশেষত খাবারদাবারের দাম বাড়বে। তাই এই রফতানির ওপরেও কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রয়োজন।
শেষে, বহুজাতিকদের সর্বগ্রাসী উপস্থিতি নিয়ে এটুকুই বলার যে, এখানে প্রতিযোগিতাটা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোটখাটো দোকানের সঙ্গে দৈত্যাকার বিপণিদের। এই সংঘাতে কে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে বলা শক্ত। এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষই পাশাপাশি অবস্থান করছে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.