সংযত আর অবনত, শব্দ দুইটির অর্থ ভিন্ন, কিন্তু সংযত করিবার নামে অবনত করিয়া রাখার অভ্যাস নূতন নহে। বিশেষ করিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের হাসিতে, চলিতে, বলিতে দেখিলেই পুরুষরা সচরাচর ভ্রুকুঞ্চন করিয়া ভাবেন ঘর-সংসার গোল্লায় গিয়াছে। এই হাস্যময়, বাকবিলাসী, চলনসই নারীরা নাকি আদতে লাস্যময়ী, স্বেচ্ছাচারী। সুতরাং তাহাদের থামাইতে হইবে সংযতবাক, বাধ্য জীবে রূপান্তরিত করিতে হইবে। এমন কথা যুবাপুরুষদের বড় একটা শুনিতে হয় না। মেয়েদের বেলায় কিন্তু সমাজের কুলগুরুরা দলবদ্ধ ভাবে ফতোয়া জারি করিয়া থাকেন। সংযমের দোহাই দিয়া পুরুষালি সমাজ মেয়েদের অবনত করে। সম্প্রতি রাজস্থানের একটি গ্রামে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াছে। দৌসা জেলার ভান্দারেজে পঞ্চায়েত বলিয়া দিয়াছে, মেয়েদের মোবাইল লইয়া মাতামাতি নিষিদ্ধ, চলভাষে আর কথা বলা চলিবে না। পঞ্চায়েতের মাতব্বরদের মতে, মোবাইল কৌম সমাজের মন ও মূল্যবোধকে বিনষ্ট করিতেছে, মেয়েরা এই যন্ত্রমাধ্যমে তাহাদের পছন্দের পুরুষের সহিত যথেচ্ছ বাক্যালাপ করিতেছে, আবার পার্শ্ববর্তী গ্রামযুবার সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া গৃহত্যাগ করিতেছে, অতএব মহিলাদের হস্তে আর মোবাইল নহে।
ইহা পুরুষতন্ত্রের হাস্যকর যুক্তি। এ কথা ঠিকই যে, ভারতীয়গণ অনেকেই মোবাইল নামক যন্ত্রটিকে ঠিক সামলাইয়া উঠিতে পারেন নাই। মিটিং-এ বসিয়া মোবাইলে কথা বলা, প্রেক্ষাগৃহে ঢুকিয়া অপর দর্শকের কথা না ভাবিয়া মোবাইল-আলাপ, কানে মোবাইল দিয়া গাড়ি চালাইয়া দুর্ঘটনায় পড়া ও ফেলা, ইত্যাদি বিবিধ কু-অভ্যাস ভারতীয়দের রহিয়াছে। পুরুষদের তো বটেই, মেয়েদেরও। এই আচরণ শোধরানো প্রয়োজন, সকলেরই। কিন্তু মোবাইল-মত্ততা বন্ধ করিবার নামে রাজস্থানের ওই গ্রামটিতে মেয়েদের উপর যে ক্ষণে ফতোয়া নামিয়া আসে সেই ক্ষণে বোঝা যায়, এই দেশ পুরুষতন্ত্রকে গভীর ভাবে লালন করে। যদি ধরিয়া লওয়া হয় মোবাইলে কথা বলা খারাপ, তাহাতে সমাজের বিধি লঙ্ঘিত হইতেছে, তাহা হইলে শুধু মহিলাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিবার অর্থ কী? পুরুষদেরও তো একই সঙ্গে আটকাইতে হইবে! ধর্ষিত হইলে যেমন ধর্ষক পুরুষের দিকে অঙ্গুলি না তুলিয়া সমাজ অনেক সময় মেয়েটিকে দোষ দেয় ইহাও যেন সেই রূপ। যদি বন্ধই করিতে হয় তাহা হইলে নারী-পুরুষ উভয়কেই মোবাইল হইতে দূরে রাখিতে হইবে। তাহা না করিয়া একমাত্রিক ভাবে মেয়েদের দোষ দেওয়া হইতেছে। এক অর্থে, ইহা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গভীর সংকটের পরিচায়কও বটে। সেই তন্ত্র মনে মনে জানে, সময় বদলাইয়াছে, মেয়েরা আগাইয়াছে, আরও আগাইবে। সত্য ও ভ্রম, কোনটা কাহার পক্ষে কী, তাহা নিজেরাই বুঝিয়া লইবে। সমাজ নামক বালির বাঁধ ভাঙিয়া পড়িতেছে, আরও পড়িবে। মরিয়া পিতৃতন্ত্র এই নিয়তিকে বাধা দিতে চাহে। অতএব মোবাইল শাসনে পঞ্চায়েতি রাজ। |