অপছন্দের মতামত দমন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হইল সেই মত পোষণকারী বা প্রচারকারীকে দমন করা। জোসেফ স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে ইহা করা হইত ভিন্নমতাবলম্বীকে অদৃশ্য করিয়া দিয়া, সে সাইবেরিয়ার গুলাগে নির্বাসিত করিয়াই হউক কিংবা কেজিবির গুপ্তঘাতকের গুলিতে খতম করিয়া। অতঃপর সেই বিদ্রোহী কিংবা বিক্ষুব্ধের আর হদিশ মিলিত না, তিনি ইতিহাস হইতে হারাইয়া যাইতেন। জর্জ অরওয়েল রচিত ‘নাইন্টিন এইট্টি ফোর’-এর সেই দুঃস্বপ্ন-বাস্তব রাশিয়া ও চিনে কায়েম হইলেও ভারতের মতো দেশের দীর্ঘকাল স্তালিন-অনুরাগী শাসিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অবিকল ওই রূপ ও প্রকরণে ব্যক্ত হয় নাই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা প্রধানত ডিওয়াইএফ নামক যুব সংগঠনের ঝটিকাবাহিনীর ‘প্রতিবাদ’ সংগঠিত করিয়া কিংবা সরকারি প্রেক্ষাগৃহ হইতে ‘অস্বস্তিকর’ নাটক বা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী প্রত্যাহার করিয়া সেন্সরশিপ চালু রাখিতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস যে ‘পরিবর্তন’-এর আশ্বাস দিয়াছিল, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বরদাস্ত করিতে না-পারার বাম ঐতিহ্যে অন্তত তেমন কিছু ঘটিল না। সরকারি প্রেক্ষাগৃহ স্টার-এ ‘তিন কন্যা’র প্রদর্শনী বন্ধের কৌশল তাহার প্রমাণ।
এই চলচ্চিত্রের গল্পাংশে নাকি সাম্প্রতিক একটি ধর্ষণ কাণ্ডের এবং সেই অপকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীর অসংবেদী প্রতিক্রিয়ার ছায়া পড়িয়াছে। ইহা শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর হইতেই পারে। কিন্তু কেবল সেই জন্য এই চলচ্চিত্র দেখার অধিকার হইতে রাজ্যবাসীকে বঞ্চিত করার স্থূল কৌশলের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বৈরাচারের গন্ধ আছে। সরকারের সমালোচনামূলক কোনও কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-গান-নাটক-চলচ্চিত্র চর্চা করা যাইবে না, কেবল সরকার অনুমোদিত কিংবা তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রকের মঞ্জুর করা সংস্কৃতিই রাজ্যবাসীকে গলাধঃকরণ করিতে হইবে, ইহা স্পষ্টতই স্বৈরাচার। বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ শাসনকালে এই স্বৈরাচার পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশে অবরোধ সৃষ্টি করিয়াছিল, ঠিক যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা সমাজতন্ত্রী চিনে সংস্কৃতিচর্চা এক বন্ধ্যা পুনরাবর্তনের নিষ্ফল সৃজনহীনতায় অধঃপতিত হয়। এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ‘সংস্কৃতিসচেতন’ রাজনীতিক হওয়ায় সেই বন্ধ্যাত্বের আবাদ যেমন ব্যাপক হয়, স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রও তেমনই নিয়ন্ত্রিত হইয়া ওঠে। বাম জমানায় যে সকল নাট্যকারের উপর শাসক দলের রক্তচক্ষু বর্ষিত হয়, তাঁহাদের এক জন বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রী, অন্য জনও মুখ্যমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’। দুর্ভাগ্যের বিষয় ইহাই যে, নিজেরা সাংস্কৃতিক স্বৈরাচারের শিকার হইয়াও আজ তাঁহারা সেই স্বৈরাচারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শরিক। যে মহাকরণে যাইবে, তাহাকেই স্তালিন হইতে হইবে? ইহাই পশ্চিমবঙ্গের নিয়তি?‘তিন কন্যা’ চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন না হওয়ার পিছনে রকমারি অজুহাত, অপযুক্তি, দায় এড়ানো চাপান-উতোর শুনা যাইতেছে। তবে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে যে, শাসকের বিরাগ উৎপাদনই চলচ্চিত্রটির কাল হইয়াছে। পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরাগ উৎপাদন করিয়াও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাম আমলে মঞ্চস্থ হইতে পারে নাই। কলিকাতার প্রেক্ষাগৃহে জামাইকান র্যাপ-রেগে সঙ্গীতের প্রখ্যাত প্রবক্তা ড. এলবান-এর সঙ্গীতানুষ্ঠান কিংবা ইডেন উদ্যানের খোলা মঞ্চে ক্যারিবীয় ক্যালিপ্সো নৃত্যগীতের অনুষ্ঠানও মুখ্যমন্ত্রী তথা সংস্কৃতিমন্ত্রীর আপত্তিতে বন্ধ হইয়া যায়। রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচরণ বা ভিন্নমতের কারণে নিষেধাজ্ঞার দৃষ্টান্তগুলি তো বহুচর্চিত। এই অসহিষ্ণুতা পরিবর্তনের সরকারকেও ছাড়িয়া যায় নাই। কার্টুন-অসহিষ্ণুতা দিয়া যাহার শুরু, ধাপে-ধাপে তাহা অপছন্দের সংস্কৃতিকে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করার ঐতিহ্য আত্মস্থ করার দিকেই অগ্রসর হইতেছে। সমাজতন্ত্রে রাজনৈতিক কুলপতি যেমন সব দিকে নজর রাখিতেন, বাম আমলে ডিওয়াইএফ-এর যূথবদ্ধতা, পরিবর্তনের বাংলায় তেমন দিদিভাই ও তাঁহার সতর্ক ভাইসকল সেই নিশ্ছিদ্র নজরদারির ঠিকা লইয়াছেন। তাহার ফাঁক গলিয়া কাহার সাধ্য স্বাধীন সংস্কৃতি চর্চা করে? স্তালিন দীর্ঘজীবী হউন! |