ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর গতি কি রুদ্ধ হতে চলেছে? সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এমনই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই প্রকল্পকে।
এই প্রকল্পে রেল ও কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন, দুই মন্ত্রকই প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। রেল তো বটেই, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকেও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তৃণমূলের। ফলে যে ভাবে কাজ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এখন কেন্দ্রীয় সরকার ছেড়ে তৃণমূল বেরিয়ে আসার পরে তাতে কিছুটা ভাটার টান। উঠছে প্রশাসনিক ঢিলেমির অভিযোগও। সব মিলিয়ে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ দ্রুত শেষ করার বিষয়টি নিয়ে ক্রমেই দানা বাঁধছে সংশয় ও সন্দেহ।
রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছিলেন। রেল মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনিই এই প্রকল্পকে আনেন রাজ্যের হাতে। পরবর্তীতে তৃণমূল কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার পরে ফের এই প্রকল্পে রাজ্য সরকারের অংশটি রেলকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এত দিন কেন্দ্রের তরফে বিষয়টি দেখভাল করছিল নগরোন্নয়ন মন্ত্রক। তাদের সঙ্গে এখন ফের রেল যুক্ত হওয়ার কথা।
তবে, প্রশাসনিক ভাবে ঠিক করা হলেও ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোয় রাজ্যের শেয়ার এখনও রেলের হাতে পুরোপুরি যায়নি। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রাজ্যের হাত থেকে রেলের হাতে এসেছে। কিন্তু সরকারি ভাবে সেই প্রক্রিয়াও এখনও শুরু হয়নি। রাজ্যের হাত থেকে রেল ওই প্রকল্পটি অধিগ্রহণ করতে গেলে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তাদের শেয়ারও নিয়ে নিতে হবে। কিন্তু রাজ্যের বক্তব্য, শেয়ার বা অংশ হস্তান্তর করতে গেলে কার নামে হবে তা আগে জানা প্রয়োজন। তা জানতে চেয়ে রাজ্যের তরফে রেল বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রেলের তরফে তার জবাব আসেনি। ফলে হস্তান্তর এখনও করা যায়নি। আর তাই সংশোধনীও করা যায়নি।
এর পাশাপাশিই উঠেছে কাজে ঢিলেমির অভিযোগ। বিধাননগর থেকে শিয়ালদহ হয়ে হাওড়া যাওয়ার কথা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর। দু’দিক থেকেই কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক চলার পরে কাজটি প্রায় থেমেই গিয়েছে। হাওড়ার তলা দিয়ে কোন পথে মেট্রো আসবে শিয়ালদহে, সেটাও ঠিক হয়নি। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর প্রশাসনিক কাজ যে ঠিকমতো হচ্ছে না, তা মেনে নিয়েছেন রেল বোর্ডের পদস্থ কর্তারা। রেল বোর্ডের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর (তথ্য) চন্দ্রলেখা মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজকর্ম একটু ঢিমেতালে চলছে ঠিকই। তবে প্রকল্পটি রেলের হাতে নেওয়ার বিষয়টি যতটা সম্ভব শীঘ্র করার চেষ্টা চলছে। ওই প্রক্রিয়া শেষ হলেই কাজে গতি এসে যাবে।”
এই অবস্থায় ‘কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেড’ (কেএমআরসিএল) কর্তৃপক্ষের এমডি ও ডিরেক্টরের বিরোধের জেরে প্রশাসনিক কাজকর্মও থমকে। ইতিমধ্যে অনেক পদাধিকারীই এই সংস্থা ছেড়ে গিয়েছেন। যেমন চলে গিয়েছেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার দুলালচন্দ্র মিত্র। গত ১৯ তারিখ সংস্থার ডিরেক্টরের সঙ্গে গোলমালের জেরে ফিন্যান্স অফিসার কিশোর সেনগুপ্তকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ জারি হয়। পরে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে বৃহস্পতিবার তাঁকে ফেরানো হয়। দুলালবাবুর বক্তব্য, “কেএমআরসিএল নিজেদের প্রশাসনিক বিরোধ না মেটালে কাজের আরও ক্ষতি হবে।”
রেল সূত্রে খবর, বিধাননগর থেকে শিয়ালদহ যেতে গেলে দত্তাবাদে প্রায় ৩৫০ মিটার লাইন পাততে হবে। কিন্তু ওই এলাকায় সরকারি জমিতে দখলদারেরা রয়েছেন। তাঁদের সরানোর ব্যবস্থা করবে কে? রাজ্য সরকার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। ফলে কোনও কাজই করা যাচ্ছে না। আবার হাওড়া ময়দানের পরে গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো আসবে ঠিকই, কিন্তু কোন এলাকা দিয়ে তা অন্য পাড়ে উঠবে ঠিক হয়নি তা-ও। ফলে সুড়ঙ্গও খোঁড়া যাচ্ছে না। বলা হয়েছিল, পুরনো নকশা পাল্টানো হবে। কিন্তু নতুন নকশা আজও হয়নি।
ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পে দু’হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালে বিধাননগর থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত নতুন এই প্রস্তাবিত মেট্রো চালু হওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জটিল আকার ধারণ করার ফলে অগত্যা আপাতত ঝুলেই রয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ভবিষ্যৎ। রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের মতে, রেলমন্ত্রী পবন বনসলের উচিত অবিলম্বে জট ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, “এই প্রকল্প রাজ্যের সবাই চান। তাই রেলমন্ত্রীর উচিত তিন পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসা। যাতে জট কাটে।” তাঁর দাবি, রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও এই রাজ্যের। তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হোক জট ছাড়ানোর। |