এক সমুদ্র স্বতঃস্ফূর্ততায় যেন এক ফোঁটা রাজনীতির চোনা!
রবীন্দ্র সদনে রবিবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ জনদের তরফে তাঁর স্মরণ-সভায় আমন্ত্রণ ছিল না রাজনীতিকদের। ভিড় উপচে পড়েছিল রাজনৈতিক দখলদারি মুক্ত সেই স্মৃতি-তর্পণে। যাকে সংস্কৃতির দুনিয়ায় রাজনীতির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতার নীরব কিন্তু বলিষ্ঠ বার্তা বলেই মনে করেছে সাংস্কৃতিক জগৎ। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের শ্রোতা হিসাবে উপস্থিতি কিছু কূট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে! তা হলে কি খুব স্পষ্ট বার্তাও পড়তে অসুবিধা হয় রাজনীতিকদের? তাঁদের না-চাইলেও রাজনীতিকদের একাংশ ঢুকে পড়তে চান অরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে?
রবীনবাবুর উপস্থিতির কথা জেনে এক সুনীল-অনুরাগীর সরস আক্ষেপ, “শুচি বস্ত্রে প্রার্থনাস্থলে যাওয়ার মধ্যে যে পবিত্র-পবিত্র ভাব আছে, সেখানে আচমকা কাউকে এলোমেলো ভাবে এসে পড়তে দেখলে যে অস্বস্তি হয়, এটাও অনেকটা সে রকম! রাজনীতির ছোঁয়া বাঁচিয়েই পুরো অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে সর্বাঙ্গসুন্দর হত। উদ্যোক্তাদের এই ব্যাপারে কোনও ত্রুটিও ছিল না।”
রবীনবাবু ছাড়াও এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রবিবারের রবীন্দ্র সদনে হাজির ছিলেন। প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় (কাকা)। ভিড় দেখে যিনি বলেছেন, ক্ষমতার রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মানুষের নীরব প্রতিবাদের কথা তাঁর মনে হয়েছে। অসীমবাবু শ্রোতার আসনে লেখক শংকরের পাশে বসে ছিলেন। রবীনবাবু ছিলেন মঞ্চের পিছনে। পাদপ্রদীপের আলোয় আসেননি। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের প্রশ্ন, অসীমবাবু থাকতে পারলে একা রবীনবাবু তাল কাটার দোষে দুষ্ট হবেন কেন! রবীনবাবুরও ব্যাখ্যা, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি স্মরণ-সভায় থাকতে চেয়েছিলেন। রাজনীতির উপস্থিতি ঘোষণা করতে যাননি।
সিপিএম অবশ্য দলীয় প্রতিনিধি হিসাবে কাউকে সুনীল-স্মরণে পাঠায়নি। আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণও ছিল না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর সাহিত্যানুরাগের সূত্রেই প্রয়াত সুনীলের দীর্ঘ দিনের পরিচিত ছিলেন। তিনি গেলেও কেউ হয়তো বিরূপ প্রশ্ন তুলতেন না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও ব্যক্তিগত স্তরে সুনীলের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু রবীন্দ্র সদনেই সুনীলের মরদেহে শ্রদ্ধা জানালেও রবিবারের স্মরণ অনুষ্ঠানে বুদ্ধ-বিমান বা সূর্যকান্ত মিশ্র কেউই যাননি। বিরোধী দলনেতা তখন কলকাতায় ছিলেনও না। ব্যতিক্রম রবীনবাবু।
রবীনবাবুর বক্তব্য, “প্রতি বছর ৭ সেপ্টেম্বর সুনীলদা’র জন্মদিনে দেখা করতে যেতাম। এ বারও গিয়েছি। সুনীলদা’র প্রয়াণের দিন, তার পরের দিন বাড়িতে গিয়েছি। শেষকৃত্যের দিন কলকাতায় ছিলাম না। স্মরণ-সভার আগের দিন বাড়িতে স্বাতীবৌদি এবং ওঁদের ছেলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ব্যক্তিগত ভাবেই মনে হয়েছিল বলে শ্রোতা হিসাবে আমি রবীন্দ্র সদনে গিয়েছিলাম।”
বহু আগে সত্যজিৎ রায় বা সাম্প্রতিক কালে সুচিত্রা মিত্র, রমাপ্রসাদ বণিকের শেষ কৃত্যে দেখা গিয়েছিল রবীনবাবুকে। এবং তাঁর দাবি, এর মধ্যে কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল, এই রকম কোনও বিচার নেই। এক কালে ছিলেন বালিগঞ্জের বিধায়ক। ‘বালিগঞ্জ সম্মিলনী’ সূত্রেও সুনীলের সংস্পর্শে এসেছিলেন। রবীনবাবুর কথায়, “নিশ্চয়ই আমার প্রথম পরিচয় রাজনীতির। আমি তো স্মরণ-সভায় রাজনৈতিক খবরদারি করতে যাইনি! কোনও কথাও বলিনি। শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারি না?”
অথচ এই রাজনীতির পরিচয়ের জন্যই ইচ্ছা থাকলেও সুনীল-স্মরণে যাননি পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড। তাঁদের দলীয় পত্রিকার সাহিত্য-সংখ্যায় ২০০১ থেকে লেখক ছিলেন সুনীল। রবীন্দ্র সদনে লেখকের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন সস্ত্রীক সমীরবাবু। তাঁর কথায়, “রবিবারও যেতে পারতাম। কিন্তু ঘোষিত ভাবেই যে হেতু রাজনীতির লোকজনকে ডাকা হয়নি, তা-ই শেষ পর্যন্ত যাইনি।”
সুনীলের শেষকৃত্যে থাকা মন্ত্রীদের কেউও স্মরণ-সভায় যাননি। সম্ভবত বার্তা পড়েই। মহম্মদ সেলিমের মতে, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরাগী, গুণগ্রাহী অসংখ্য। তাঁদের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গিয়ে ফুল দিতে বা শ্রদ্ধা জানাতেই পারেন। প্রশ্নটা তো রাজনৈতিক খবরদারি নিয়ে! রবিবারের স্মরণসভাকে সেই রাজনৈতিক প্রবণতার বিরুদ্ধে একটা বার্তা বলা যেতে পারে।”
এক তরুণ সাহিত্যিকের কথায়, “এ তো দেখা যাচ্ছে ছিদ্রপথ পেলেই রাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে। তবে যা-ই হোক, পরিবেশ বুঝে তাঁরা সংযত থাকলে ভাল!” |