একে বোধ হয় বলা যেতে পারে ‘গলছে কিন্তু গিলছে না’ কূটনীতি।
সম্পর্কের বরফ গলাতে ভারত সফর সেরে গেলেন বাংলাদেশের বিরোধী দলনেত্রী খালেদা জিয়া। বলা যায় সসম্মানে তাঁকে ডেকে এনে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধীর পুত্রবধূ সনিয়া গাঁধী শেষ পর্যন্ত খালেদার সঙ্গে একান্ত বৈঠক থেকে বিরত থাকলেন। আওয়ামি লিগ ও শেখ হাসিনার পরিবার ও সরকার, উভয়ের সঙ্গে গাঁধী পরিবারের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে সচেতন ভাবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
প্রথমে ঠিক ছিল, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন জোটের চেয়ারপার্সন সনিয়ার সঙ্গেও তাঁর সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু সাত দিনের সফরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেও বৈঠকটি হল না। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, খালেদা ফিরে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লিতে আসছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভি। বিদেশ মন্ত্রকের এক কূটনীতিকের ভাষায়, “ভারতের বিদেশ নীতি হল মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর শাড়ির মতো। এই বিদেশ নীতিতে অনেক স্তর। এটা সাদা-কালো, হ্যাঁ অথবা না কিংবা শঠে শাঠ্যংয়ের কূটনীতি নয়।”
খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য একে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। খালেদার সফরসঙ্গী এক প্রতিনিধির কথায়, “খালেদা এই সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের সঙ্গে তাঁর সখ্যর একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাইছেন। কাজেই তাঁর দিক থেকেও এটা হচ্ছে বরফ গলানোর একটা প্রয়াস। খালেদার শরিক হল জামাত। ভারত ঘোরতর ভাবে জামাত-বিরোধী। ক’দিন আগেও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জামাত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। খালেদা নিজেও তাঁর রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বিরোধিতার তাসকে ব্যবহার করে এসেছেন। তাঁর দল বিএনপি-র সঙ্গে চিন ও পাকিস্তানের অক্ষ নিয়ে ভারতের কূটনীতিতে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তাই এখনই বিরোধী নেত্রী হিসেবে খালেদার প্রথম সফরেই তিনি ভারতের মন সম্পূর্ণ জয় করে কেল্লা ফতে করে দেবেন, এমন অতি-প্রত্যাশা খালেদারও নেই। তাঁর কূটনৈতিক রণকৌশল হল, নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল। শূন্যের থেকে এক ভাল।
সনিয়ার এই দেখা না করার অবশ্য একটি যুক্তিও দিচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক সূত্র। তা হল, সনিয়া কিন্তু ভারত সরকারের অঙ্গ নন। তিনি ইউপিএ-র সভানেত্রী, কংগ্রেসের দলনেত্রী। আর কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, খালেদার সঙ্গে সনিয়ার বৈঠক না করার ঘটনাটি একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সনিয়া-খালেদা বৈঠকে বসলে তার অর্থ, বিএনপির সঙ্গে কংগ্রেসের রাজনৈতিক সম্পর্কে একটা নতুন মাত্রা যোগ হওয়া। ক’দিন আগে শেখ হাসিনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে মরণোত্তর সম্মান দিয়েছেন। পুত্রবধূ হিসেবে সনিয়া ঢাকায় গিয়ে সেই সম্মান গ্রহণ করেছেন। এর পরেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতের আরও কিছু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ সম্মান দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শেখ হাসিনার কন্যা কিছু দিন আগে দিল্লি এসে রাষ্ট্রপতি, সনিয়া এমনকী, প্রিয়ঙ্কা বঢরার সঙ্গেও ঘরোয়া বৈঠক করে গিয়েছেন। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ইন্দিরার স্মৃতিবিজড়িত অধ্যায়ের কথা মাথায় রেখে আওয়ামি লিগ ও কংগ্রেসের সম্পর্কে সামান্যতম চিড় ধরাতেও রাজি নন কংগ্রেস সভানেত্রী।
তবে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে একে জড়াতে রাজি নয় বিদেশ মন্ত্রক। তাদের বক্তব্য, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিন্তু আওয়ামি লিগ ও কংগ্রেসের সম্পর্ক নয়। সেখানে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক। যে কারণে হাসিনা দিল্লি এলে আডবাণী বা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেন, সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিও খালেদার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। খালেদার সফরের আগেই বিষয়টি ভারতের পক্ষ থেকে হাসিনাকে বোঝানো হয়েছিল। হাসিনারাও অবশ্য খালেদার এই সফরের মধ্যে তাঁদের রাজনৈতিক লাভই দেখছেন। কারণ, খালেদার ভারত সফরের ফলে বিএনপির পক্ষে হাসিনার বিরুদ্ধে ভারত-বিরোধিতার তাসকে ব্যবহার করাটা কঠিন হবে ভোটের আগে। |