মাওবাদী-যোগে বিতর্ক জঙ্গলমহলের সিপিএমে |
পঞ্চায়েত ভোটের আগে জঙ্গলমহলে এ বার জোড়া সঙ্কটে পড়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। এক দিকে, মাওবাদীদের গণসংগঠনের সদস্য-সমর্থকেরা পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ালে তাঁদের পরোক্ষে সমর্থন করা হবে কি না, তা নিয়ে দলে বিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। আবার ভোটে জিতে পঞ্চায়েত দখল করতে পারলে প্রধান ও উপ-প্রধান নির্বাচনে তাঁদেরই মতামত মেনে নিতে হবে বলে দলের নিচু তলার কর্মীরা দাবি করতে শুরু করেছেন। পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতির সময় এই জোড়া বিতর্ক সামলাতে মাথা ঘামাতে হচ্ছে সিপিএম নেতৃত্বকে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের গণসংগঠন ‘পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’র সদস্য-সমর্থকদের একটি অংশ তৃণমূলে যোগ দিলেও অন্য একটি অংশ শাসক দল তথা সরকারের উপরে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। কমিটির ওই অংশটি ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গলমহলের বহু এলাকায় নির্দল প্রার্থী দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবং তাদের মূল লক্ষ্য, যেখানে যেখানে বিরোধীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে পারবে না, সেখানে প্রার্থী দাঁড় করানো। জঙ্গলমহলে সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব এখনও পর্যন্ত ওই নির্দলদের পরোক্ষে সমর্থনের কথা ভাবলেও পার্টির নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা মাওবাদীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চান।
মাওবাদী-প্রশ্নে দলের মধ্যে এই বিরোধের আবহের মধ্যেই জঙ্গলমহলে সিপিএমের নিচু তলার সদস্যদের একাংশ সম্প্রতি জেলা নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু প্রার্থী বাছাই করাই নয়, ভোটে কোনও গ্রাম পঞ্চায়েত জিতে নিতে পারলে সেখানকার প্রধান ও উপ-প্রধান নির্বাচনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্থানীয় নেতৃত্বের হাতেই দিতে হবে। ২০১১-এ রাজ্যপাট হারানোর আগে পশ্চিমবঙ্গে দলের নিচু তলার সদস্যদের এ ভাবে নিজেদের অধিকার নিয়ে সরব হতে দেখা যায়নি।
লক্ষ্যণীয়, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জঙ্গলমহলের এই তিনটি জেলার মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটে নিচু তলার হাতে ক্ষমতা চেয়ে সব চেয়ে সরব পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূল স্তরের সিপিএম কর্মীরা। ২০০৮-এর নভেম্বরে লালগড় আন্দোলন শুরু হওয়া ইস্তক শুধু ওই জেলাতেই প্রায় আড়াইশো দলীয় কর্মী মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন। গোটা জঙ্গলমহলে যে-সংখ্যাটা তিনশোর বেশি। লালগড়, বেলপাহাড়ি, জামবনির মতো জায়গায় সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্ব এখন এমনও অভিযোগ আনছেন যে, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে লোকাল ও জোনাল কমিটির মতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জেলা স্তরের কোনও কোনও নেতা মোটা টাকার বিনিময়ে বিতর্কিত দলীয় সদস্যদের গ্রাম পঞ্চায়েত কিংবা পঞ্চায়েত সমিতিগুলির পদাধিকারী করেছিলেন। তার পরিণামে লালগড় আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে ও গত বিধানসভা নির্বাচনে আখেরে মাসুল দিতে হয়েছে দলকেই।
২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট জঙ্গলমহলের তিনটি জেলায় ৭২৭৪ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ৪৯৮২, পঞ্চায়েত সমিতির ১৬৫২-টির মধ্যে ১২৭০ ও জেলা পরিষদের ১৪০-এর মধ্যে ১২৯টি পেয়েছিল। কিন্তু দলেরই হিসেবে, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে ওই সাফল্য অর্ধেকে গিয়ে ঠেকেছে।
দলীয় সূত্রের খবর, তিনটি জেলাতেই সিপিএমের উচ্চ নেতৃত্ব মাওবাদীদের দাঁড় করানো নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে কোনও স্পষ্ট অবস্থান এখনও নিতে পারেননি। সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির সদস্য তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “মাওবাদীদের দাঁড় করানো নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করা মানে খাল কেটে কুমির আনা! আমরা, দলের স্থানীয় সদস্য-কর্মীরাই মাওবাদীদের হাতে পড়ে পড়ে মার খেয়েছি। কোনও নেতা দেখতে আসেননি। তাই তৃণমূল ও মাওবাদীদু’পক্ষের সঙ্গেই আমরা সমদূরত্ব বজায় রাখব। স্থানীয় স্তরে এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও জঙ্গলমহলের অন্যতম বাঁকুড়া জেলার সম্পাদক অমিয় পাত্র অবশ্য বলেন, “তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ জঙ্গলমহলের কোনও কোনও জায়গায় নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করতেই পারেন।” পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক প্রবীণ সদস্যের বক্তব্য, “মাওবাদীরা কোনও কোনও জায়গায় নির্দল প্রার্থী দাঁড় করাবে। তাঁদের আমরা ভিতরে ভিতরে সমর্থন দেব কি না, পরে ঠিক হবে।”
আর নিচু তলার কর্মীদের দাবি সামলাতে কী করবেন সিপিএম নেতৃত্ব? অমিয়বাবুর বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোটের পরে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে পদাধিকারী নির্বাচন করে দলের লোকাল কমিটি এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে জোনাল কমিটি। জেলা নেতৃত্ব তাতে সিলমোহর দেয় মাত্র। আমাদের দলে এটাই নিয়ম। কিন্তু আগে কোনও কোনও জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে পারে। এ বার তা নিয়ম অনুযায়ীই করা হবে।” |