প্রাক্তন কর্মীর স্ত্রী আত্মঘাতী |
রবীন্দ্র -পাঠ থেকে পাঠান্তর চেনাতে সাইবার - ‘বিচিত্রা’ |
‘ওই যে আসে শচী সেন, মণি সেন, বংশী সেন।’
অনেকেরই ছোটবেলার স্মৃতিতে আছে ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের লাইনটা।
কিন্তু পড়তে গিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল শঙ্খ ঘোষের। রবীন্দ্রনাথ তো ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগে কোনও অনুস্বর ব্যবহার করেননি ! একটি শিশু তবে কী করে পড়বে ‘বংশী সেন’? সংশয় মিটল পাণ্ডুলিপি দেখে। সেখানে ‘বংশী’ শব্দটি নেই, আছে ‘বশী’। আর, বশী সেন নামে রবীন্দ্রনাথের পরিচিত এক জন তো ছিলেনই। শঙ্খবাবু বলছিলেন, “আসলে রবীন্দ্রনাথ ওখানে অনুস্বর ব্যবহার করেননি।” কারণ, পাঠ তো বানান অনুযায়ী সাজানো। ‘সহজ পাঠ’ দ্বিতীয় ভাগের প্রথম পাঠটাই অনুস্বর দিয়ে তৈরি শব্দের তালিকা। “অর্থাৎ শিশু প্রথম অনুস্বর চিনবে ওইখানে এসেই। কিন্তু মুদ্রিত সংস্করণে ‘বংশী’ শব্দটি ছিল প্রথম ভাগে। ফলে পাঠের যুক্তিটা গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল।”
এই মুদ্রণ প্রমাদের খবর এখন আর পাঠকের অজানা নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলির ষোড়শ খণ্ডে (২০০১ ) এর উল্লেখ আছে। এ বার পাঠকের নাগালে আসতে চলেছে গোটা রবীন্দ্র -পাণ্ডুলিপিরই সম্ভার ! মাউসের একটা ক্লিকে !
আজকের দিনে ইন্টারনেটে রবীন্দ্র রচনাবলি পড়ে ফেলতে চাইলে রয়েছে একাধিক ওয়েবসাইট। কিন্তু পাণ্ডুলিপি? বা প্রথম সংস্করণ -সহ বিভিন্ন মুদ্রিত সংস্করণ? এত দিন এ সবের সন্ধানে রবীন্দ্রভবন (বিশ্বভারতী ) , জাতীয় গ্রন্থাগার বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ -এর মতো সংগ্রহশালায় গিয়ে প্রভূত সময় ও শ্রম দান করা ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প ছিল না। শঙ্খবাবুও রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে দেখেছিলেন রবীন্দ্র ভবনে গিয়েই। সেই সিন্দুকের চাবিকাঠি এ বার সর্বসাধারণের মাউসের ডগায় এনে দিতে চলেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’ (এসসিটিআর )-এর ‘বিচিত্রা প্রকল্প’। |
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অর্থানুকূল্যে ২০১১ সাল থেকে এই কাজ চলছে। বিশ্বভারতীর সহযোগিতায় এই প্রকল্পে গড়ে তোলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় সাহিত্যকর্মের (চিঠিপত্র বাদে ) বৈদ্যুতিন আর্কাইভ। যা সম্পূর্ণ হলে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি বা যে কোনও লেখার মুদ্রিত নানা প্রামাণ্য সংস্করণ পৌঁছে যাবে পাঠকের ঘরে ঘরে !
এসসিটিআর সূত্রে জানা গিয়েছে, সমস্ত কাজটাই ডিজিটাইজড হয়ে আগামী বছর মার্চের পরে একটি ওয়েবসাইট আকারে প্রকাশিত হবে। তাতে পাঠক দেখতে পাবেন কত কাটাকুটি, শব্দ ও বাক্য গ্রহণ -বর্জনের মধ্য দিয়ে এক -একটা লেখা গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক, অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলছিলেন, রোমান হরফেও এমন কাজ খুব কমই হয়েছে। এসসিটিআর -এর লক্ষ্য ছিল, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে মূল পাণ্ডুলিপি এবং মুদ্রিত নানা পাঠের প্রতিলিপিকরণ তৈরি করা। তার পর তাদের মধ্যে তুলনা করে, খুঁটিনাটি ফারাক খুঁজে বের করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমেই সবটা পাঠকের সামনে হাজির করে দেওয়া। পাণ্ডুলিপিগুলি পাওয়া গিয়েছে মূলত রবীন্দ্রভবন থেকেই। তা ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত উইলিয়াম রদেনস্টাইন সংগ্রহ থেকেও মিলেছে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। ট্রান্সক্রিপশন বা বৈদ্যুতিন প্রতিলিপিকরণ -সহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার পাতার এই ওয়েবসাইটটিকে, সুকান্তবাবুর কথায়, “রবীন্দ্র রচনার বৃহত্তম ও সুসংহত নলেজ -সাইট বলা যেতে পারে।”
পাঠকের কাছে ওয়েবসাইটটির বিশেষ আকর্ষণ হতে চলেছে অরুণাশিস আচার্য এবং স্পন্দনা ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘পাঠান্তর’ নামে একটি সফ্টওয়্যার। কী কাজ এই সফ্টওয়্যারের? প্রকল্পের দুই সদস্য, স্মিতা খাটোর এবং সহজিয়া নাথ বলেন, “ধরুন, ‘সোনার তরী’ কবিতাটি। পাণ্ডুলিপিতে এর দু’টি ভিন্ন পাঠ আছে। এ ছাড়া নানা মুদ্রিত সংস্করণ মিলিয়ে ওই কবিতাটির আরও আটটি পাঠ রয়েছে। সব ক’টি পাঠের যে কোনও একটিকে ‘মূল পাঠ’ ধরে অন্যগুলির সঙ্গে তুলনা করলে পাঠান্তরগুলি দেখিয়ে দেবে আমাদের এই সফ্টওয়্যার।”
শুধু কি তা -ই? কত জনই বা জানেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় প্রায়ই ‘র’ বা ‘য়’-এর ফুটকি দিতে ভুলে যেতেন ! কিংবা কবির স্বভাবই ছিল ‘হ্ন’কে ‘হ্ণ’ লেখার ! “গুরুগম্ভীর তথ্য ও তত্ত্বের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপিতে লুকিয়ে থাকা এমন নানা মজাদার বিষয়ও খুঁজে বের করার অবকাশ থাকছে,” সহাস্য সংযোজন প্রকল্পের আর এক সদস্য অপরূপা ঘোষের। সুকান্তবাবু বলেন, “এসসিটিআর -এ আমরা এর আগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক নথি সংরক্ষণ এবং সে সবের তালিকা তৈরির কাজ করেছি। কিন্তু তার পরের ধাপ অর্থাৎ ‘টেক্সচুয়াল এডিটিং’ বা পাঠ -সম্পাদনার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম আমরা। সেই সূত্রেই ‘পাঠান্তরে’র মতো একটি সফ্টওয়্যার তৈরির ভাবনা।” ‘পাঠান্তর’ ছাড়াও সাইটটিতে থাকছে একটি বিশেষ সার্চ ইঞ্জিন ও ফিল্টার।
প্রথমটি তৈরি করেছেন যাদবপুরেরই দুই ছাত্র অরবিন্দ মণি ও প্রকাশ কলি মই। যে কোনও শব্দ দিয়ে খুঁজলে রবীন্দ্রনাথের নানা লেখার হদিশ দেবে সার্চ ইঞ্জিন। পাণ্ডুলিপিতে কোনও লেখার চূড়ান্ত রূপটিকে বের করে দেবে, আর এক ছাত্র ভূপতি রায়ের তৈরি ফিল্টার।
প্রকল্পের উপদেষ্টাদের এক জন শঙ্খবাবু নিজেই। কী ভাবে ‘বিচিত্রা’র কাজ হচ্ছে, এসসিটিআর -এ এসে তা সরেজমিন দেখেও গিয়েছেন। তাঁর কথায়, “নিঃসন্দেহে বড় মাপের কাজ। রবীন্দ্রচর্চা যাঁরা করেন বা সাধারণ পাঠক, সবার কাছেই এটি খুব মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে।” |