প্রাক্তন কর্মীর স্ত্রী আত্মঘাতী |
মন্ত্রিগোষ্ঠী -উপদেষ্টা, পরিবহণ তবু আঁধারেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • বালুরঘাট ও কলকাতা |
সরকারি পরিবহণের হাল ফেরাতে ঢাক পিটিয়ে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রীর মাথায় বসেছে মন্ত্রিগোষ্ঠী। তার উপরে বসানো হয়েছে উপদেষ্টা। কিন্তু, বাম আমলের রুগ্ণ অবস্থা থেকে নতুন সরকার গঠনের দেড় বছর পরেও সরকারি পরিবহণের হাল যে ফেরেনি, তা যেন নিজের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গেলেন বালুরঘাটের দীপ্তি কর্মকার।
বৃহস্পতিবার সকালে বালুরঘাটের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নিজের বাড়ির জানলায় দীপ্তিদেবীর (৭৫ ) ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। দীপ্তি দেবীর স্বামী মনোরঞ্জনবাবু উত্তরবঙ্গ পরিবহণ নিগমের (এনবিএসটিসি ) কর্মী ছিলেন। ছ’বছর আগে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে মাসে ২ হাজার টাকা পেনশন পাচ্ছিলেন দীপ্তি দেবীও। পরিবারের লোকেদের দাবি, পাঁচ মাস আগে এনবিএসটিসি -র তরফে পেনশন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মাস তিনেক আগে বাড়ির কলতলায় পড়ে ওই বৃদ্ধার পা ভাঙে। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, পেনশন বন্ধ হওয়ায় চিকিৎসা ও খাওয়া -দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছিল না তাঁর। অবসাদে -হতাশায় তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন।
দীপ্তিদেবীর দেহের পাশে মেলা দু’টি ‘সুইসাইড নোট’-এ সেই বক্তব্যই কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি নোটে তিনি লিখেছেন, ‘চরম অসুস্থতায় ব্যথা -বেদনা সহ্য করতে পারছি না। সংসারে দুঃখ -অশান্তি সইতে পারছি না। তাই স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ আর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য পরিবারের কেউ দায়ী নয়। তাঁর ছেলে, বউমা যথেষ্ট সেবা শুশ্রূষা করেছেন এবং তাঁর যা সম্পত্তি আছে, তা যেন সকলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। |
দীপ্তি দেবীর মৃত্যুর ঘটনা এনবিএসটিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ও তাঁদের পরিবারের লোকজনদের অনেককেই আতঙ্কিত করে তুলেছে। শঙ্কিত কর্মরতরাও। কারণ, কর্মীদের মাইনে দিতে মাস গড়িয়ে যাচ্ছে। তা -ও পুরো মাইনে হাতে পাচ্ছেন না কর্মীরা। তা নিয়ে নানা স্তরে আন্দোলন, সরকারের আশ্বাস মিললেও কাজের কাজ হয়নি। কয়েক মাস আগেই দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন হাওড়ার ঘাসবাগান ডিপোর এক সিএসটিসি কর্মী।
পেনশন নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন এনবিএসটিসি -র ম্যানেজিং ডিরেক্টর সি মুরুগণ। তাঁর বক্তব্য, “প্রায় আড়াই হাজার জন পেনশন পান। ওই খাতে মাসিক প্রায় ১২ কোটি টাকা দরকার। নিগমের নিজেদেরই পেনশন দেওয়ার কথা। কিন্তু, আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে সরকারের সাহায্য ছাড়া তা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা যেমন বরাদ্দ পাচ্ছি সে ভাবে বকেয়া মেটাচ্ছি।”
দীপ্তিদেবীর মৃত্যু প্রসঙ্গে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই মর্মান্তিক। তবে আমার মনে হচ্ছে, ওঁরা রাজ্য সরকারকে ভুল বুঝছেন। আমরা কোনও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর পেনশন বন্ধ করিনি। পুজোয় ছুটি থাকার কারণে পেনশন দিতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই মৃত্যুর পিছনে শুধুই পেনশন নয়, অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে।” এনবিএসটিসি -র চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের প্রতিক্রিয়া, “দীপ্তিদেবীর মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। এমডি -র সঙ্গেও কথা হয়েছে। উনি পরিবারিক পেনশন পেয়েছেন বলেও শুনেছি। দ্রুত ওই পেনশনের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।”
মন্ত্রীরা এ কথা বললেও বাস্তব হল, সরকারি পরিবহণ নিগমগুলির ভাঁড়ে কার্যত মা ভবানী। আয় বাড়ানোর নানা উদ্যোগের কথা সরকার বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ডিজেলের দাম বাড়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন যাত্রিভাড়া না বাড়ায় বহু রুট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একের পর এক বাস বন্ধ হয়েছে। সরকারি বাসগুলির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। নতুন কেনা বাস ক’মাসেই লড়ঝড়ে চেহারা নেয়।
এনবিএসটিসি -ও এর ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত, ধুঁকতে থাকা রুগ্ণ এনবিএসটিসি যে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগোবে, তা নিয়ে অফিসার -কর্মীদের অনেকেরই সংশয় নেই। হাল ফেরাতে নতুন সরকারের দেড় বছরের আমলে নিগমের চেয়ারম্যান পর্যন্ত বদল করা হয়েছে। লাভ কিছু হয়নি। এক সময়ে ৮০০টির বেশি বাস চলত। এখন গড়ে দিনে ৩৫০টি চলে। অন্তত ২৫০টি বাস বিকল। ২০টি লাভজনক রুটের বাস ‘অজ্ঞাত কারণে’ বন্ধ। রাজ্যে নিগমের ২২টি ডিপোয় সব মিলিয়ে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৩৪০০। অস্থায়ী কর্মী প্রায় ৬০০। ফি মাসে সংস্থার আয় গড়ে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। অথচ মাইনে দিতেই খরচ প্রায় ৯ কোটি। সঙ্গে তেলের খরচ।
এ বছর জানুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে বছরে ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হওয়া নিগমগুলিকে ছ’মাসের মধ্যে লাভজনক করে তোলার ‘রোডম্যাপ’ তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময়েই নিগমগুলির হাল ফেরাতে সেগুলিকে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। পরিবহণ নিগমগুলির হাতে পড়ে থাকা জমিগুলিকে লাভজনক ভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। ওই ঘোষণার ছ’মাস পরে মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। পরিবহণ দফতরের উপদেষ্টা হয়েছেন মুকুল রায়। কিন্তু, আজও সেই একই পরিকল্পনার কথা বলে যাচ্ছেন মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ দিনও বলেন, “মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল পরিবহণের হাল ফেরাতে। তার তিনটি পদক্ষেপ। এক, বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে আসা। দুই, আয় বাড়ানো (ভাড়া বাড়িয়ে )। তিন, নিগমগুলির একত্রীকরণ।”
যদিও পরিবহণ দফতরের কর্তাদের একাংশ বলছেন, আর্থিক সংস্কারের কথা মুখে বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই বেসরকারি বিনিয়োগও আসেনি। আয়ও বাড়েনি। সাধারণ কর্মীদের বড় অংশই বলছেন, “আয় না বাড়ায় মাইনে দিতেই যেখানে সরকার হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে পেনশন তো মার খাবেই।”
এনবিএসটিসি পেনশনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মোহনবাঁশি বর্মন বলেন, “গত এক বছরে মাত্র সাড়ে চার মাসের পেনশন পেয়েছি। তা -ও অনিয়মিত। রাজ্যপাল অবধি সমস্যার কথা জানালেও এখনও কোনও কাজ হয়নি। তাই যা হওয়ার, বালুরঘাটে তা -ই হয়েছে ! ”
নিজের মৃত্যু দিয়ে আগামীর আশঙ্কা রেখে গেলেন দীপ্তি কর্মকার। |