রাজ্যের মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষা করেন দুর্গাপুজোর জন্য। নবদ্বীপের মানুষ অপেক্ষা করেন বিজয়াদশমীর। ওই রাত থেকেই নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব রাসের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়ে যায় যে।
বিজয়া দশমী এবং কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে প্রতিমার “পাটপুজো” করে রাস উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ে নবদ্বীপে। কিন্তু এ বারের উৎসবের শুরুতেই মূল্যবৃদ্ধির প্রবল ধাক্কায় ভাঁজ পড়ছে। ছোট বড় সব উদ্যোক্তাদের কপালে।
বাঁশ থেকে বাজনা। প্রতিমা থেকে পুরোহিত, আলো থেকে অন্য আয়োজনসব ক্ষেত্রে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বেড়েছে। যার নিট ফল গত বছর যে পুজোর খরচ ছিল এক লাখ টাকা, এ বার তা বেড়ে এক লাখ তিরিশ বা চল্লিশ হাজার টাকা। বাজেটের এই ঘাটতি মেটাতে নাভিশ্বাস উদ্যোক্তাদের।
নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য বিরাটাকারের সুউচ্চ প্রতিমা। ১৫ থেকে ২৫ হাত পর্যন্ত উচ্চতার প্রায় ১০০ প্রতিমা রাসে নির্মিত হয়। এই সব বড় বড় প্রতিমা মণ্ডপেই নির্মিত হয়। প্রধান নির্মাণ সামগ্রী হল বাঁশ। সেই বাঁশের দাম এ বার প্রায় দ্বিগুণ। দাম দিয়েও মিলছে না উপযুক্ত বাঁশ।
প্রতিমার বাঁশের চালি তৈরির প্রবীণ কারিগর হরিপদ হালদার বলেন, “১৮ ফুট উচ্চতার একটা প্রতিমার চালির জন্য ২৫ থেকে ৩৩টা পর্যন্ত বাঁশ লাগতে পারে। চালির নকশার কারণে কমবেশি হয়।” এ বার এক একটা বাঁশের দাম ১৯০-২০০ টাকা। গত বছরে ১১০-১৩৫ টাকায় এ সব বাঁশ পাওয়া গিয়েছে। বাঁশের দাম বাড়ায় সব থেকে সঙ্কটে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
গত বছর ৭০-৮০ টাকা দামের হালকা বাঁশ এ বার ১১০-১২০ টাকা। কেন এত দাম বাড়ল বাঁশের। বাঁশের পাইকারি বিক্রেতা শশাঙ্ক হালদার বলেন, “হঠাৎ করে বাঁশের চাহিদা খুব বেড়েছে। হালকা সরু বাঁশ রফতানি করা হচ্ছে। ওই বাঁশ দিয়ে ‘ক্রস’ তৈরির নতুন একটা রেওয়াজ হয়েছে। নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি জেলার এক বছর বয়সি বাঁশের চাহিদা খুব বেশি। ফলে স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে গিয়েছে।”
নবদ্বীপ বড়ালঘাটের ১২৬ বছরের প্রতিমা ভুবনেশ্বরী পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা কানাইবরণ পাল বলেন, “সব কিছুর দাম বেড়েছে। ধরুন গত বছর যা বাজেট ছিল, এ বার তার প্রায় চল্লিশ শতাংশ খরচ বাড়ছে। যে বাজনা গত বার ১৫ হাজার নিয়েছে, এ বার তারা ২৫ বা ৩০ হাজারের নীচে কথা বলতেই চাইছে না।” নবদ্বীপের হরিসভাপাড়া ভদ্রকালী পুজো কমিটি সাড়ম্বরে পুজো করেন। সেই ভদ্রকালীমাতা ট্রাস্টের সম্পাদক পরেশচন্দ্র নন্দী হিসাব কষে বলেন, গত বছর প্রতিমার মজুরি ছিল ৯০০০ টাকা। এ বার সেটা ১২০০০ টাকা। প্রতিমার সাজ ৬৫০০ থেকে ৯০০০ টাকা। ৮৫০০০ টাকার বাজনা বেড়ে এক লাখ। বুঝতেই পারছেন উদ্যোক্তা হিসাবে চাপ কতটা বাড়ছে। তবে এই চাপ আরও অনেক বেশি ছোট ছোট বাজেটের পুজোর উদ্যোক্তাদের ওপর। খরচ সামলাতে তারা কার্যত দিশাহারা।
আড়াইশো বছর পার হয়ে যাওয়া বিন্ধ্যবাসিনী পুজোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্ত শুভেন্দু কুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “শুধু বাঁশ কেন, প্রতিমা নির্মাণের অনেক জিনিসই আজ অমিল। যেমন দরমা। বাঁশের অভাবে ভাল দরমা মিলছে না। প্রতিমার চালি তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে। বড় খড়ও অমিল। এখন সব হাইব্রিড ধানগাছ। উচ্চতা খুব কম। ফলে লম্বা খড় হচ্ছে না। বিরাট উচ্চতার প্রতিমার কাঠামো নির্মাণে এটা প্রধান বড় সমস্যা। মাটির সঙ্গে তুষ মেলাতে হয়। ধান কলে ভাঙানো হচ্ছে। তুষ মিলছে না। দোমেটে করার কালো মাটির দাম অস্বাভাবিক। সব মিলিয়ে এত বড় প্রতিমা খুব বেশি দিন করা সম্ভব হবে না।”
নবদ্বীপের ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং রাসের উদ্যোক্তা মিহিরকান্তি পাল বলেন, “গত বছর যে ঘরামি বাঁশের চালি বানাতে ২০০০ টাকা নিয়েছে, এ বার তার মজুরি ৪০০০ টাকা। আমাদের পুজোয় ২ কুইন্টাল ভোগ হয়। রান্না হত গ্যাসে। এ বার গ্যাস মিলবে কোথায়? বোধ হয় সেই কাঠের উনুনে ফিরে যেতে হবে।”
সব মিলিয়ে নবদ্বীপ শহর জুড়ে এখন কেবলই রাসকথা। |