|
|
|
|
ফাঁস করেন পরিকল্পনাও |
এবিজি-কে সরানোর শপথ দু’বছর আগেই |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
দু’বছর আগে হলদিয়া বন্দরে মাল খালাসের কাজে নামা ইস্তক এবিজি-র পদে পদে বাধা পাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটানো যে একটা সুসংহত পরিকল্পনারই পরিণাম, তা প্রমাণ গেল। এ-ও পরিষ্কার হয়ে গেল, ওই পরিকল্পনার ‘মাথা’ হলেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী!
কী ভাবে বোঝা গেল?
২০১০-এর মার্চে এবিজি যখন হলদিয়া বন্দরে কাজ শুরুর তোড়জোড় করছে, তখন হলদিয়ার রানিচকে একটা সভা করেছিলেন শুভেন্দুবাবু। এবং তৃণমূল সাংসদ সেখানেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, এবিজি-কে তিনি হলদিয়া বন্দরে কাজ করতে দেবেন না। ওই দলীয় সভায় শুভেন্দুবাবু বলেছিলেন, “আমি স্টার্টিং-এ বিশ্বাস করি না। আমি ফিনিশিং-এ বিশ্বাস করি। নন্দীগ্রামে যখন স্টার্ট করেছিলাম, অনেকে ভয় পাচ্ছিল যে, পরিণতিটা কী হবে! ফিনিশিংটা কী হয়েছে, দেখেছেন! ২৩৫ এলোমেলো হয়ে গিয়েছে বুদ্ধ ভট্টাচার্যের। আপনাদের স্টার্টিংটা আমি করেছি। ফিনিশিংটা আমাকে করতে দিন।”
সাংসদ তাঁর কথা রেখেছেন। এবিজি শেষমেশ হলদিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাঝে এবিজি’কে ঘিরে নানা ঘটনায় তপ্ত হয়েছে বন্দর-শহর। এমনকী, এক জনের পরিবার-সহ এবিজি’র তিন অফিসারকে অপহরণের অভিযোগ ওঠার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, হলদিয়ায় কিছুই হয়নি! মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের মধ্যে কার্যত শুভেন্দু অধিকারীর এবিজি-বিরোধিতাকে সমর্থনেরই বার্তা পৌঁছেছে বিভিন্ন মহলে।
এবিপি আনন্দ সূত্রে পাওয়া ২০১০-এর মার্চে রানিচকে আয়োজিত তৃণমূলের ওই সভাটির ভিডিও-ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে, এবিজি’কে কাজ করতে না-দেওয়ার জন্য শুভেন্দুবাবু কী ভাবে দলীয় সমর্থকদের প্ররোচিত করছেন। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলছেন, “যে সমস্ত জিনিসপত্র ওরা (এবিজি) নিয়ে এসেছে, ক্রেন ইত্যাদি, সেগুলো আমরা পোর্টের মধ্যে নিয়ে চলে আসব। ওদের গেটের বাইরে থাকতে হবে। আমি এমপি হিসেবে বলে দিলাম। কারণ, তার এখন এই মুহূর্তে কোনও লোকাস স্ট্যান্ডাই নেই।”
এবিজি-কে হলদিয়া-ছাড়া করতে তাঁর ‘পরিকল্পনা’র কথাও সভায় ব্যক্ত করেছিলেন শুভেন্দুবাবু। কী রকম?
বন্দরের নতুন অছি পরিষদ (ট্রাস্টি বোর্ড)-এ নিজেদের লোক ঢুকিয়ে এবিজি-র কাজের মেয়াদবৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হবে বলে সভায় ঘোষণা করেছিলেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। বলেছিলেন, “বন্দরের বর্তমান ট্রাস্টির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ মার্চ। ৩১ মার্চের মধ্যে এবিজি-র বিষয়ে কোনও আলোচনা বর্তমান ট্রাস্টিতে হবে না। আগামী ৩১ মার্চের পরে নতুন ট্রাস্টি হবে। নতুন ট্রাস্টি আমরা বানাব। আমাদের সরকার বানাবে। তাতে আমার প্রতিনিধি থাকবে।”
সেই ট্রাস্টি কী করবে? শুভেন্দুবাবু পরিষ্কার জানান, “এপ্রিলে এবিজি-র এক্সটেনশন পিটিশনটাতে আমরা এন-ও ‘নো’ করে দেব। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। একদম নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি।” ‘পরিকল্পনা’ মোতাবেক ২০১০ সালে বন্দরের নতুন ট্রাস্টিতে নিজেদের লোক ঢুকিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ (অভিযোগ, ট্রাস্টির অন্তত তিন জন মনোনীত সদস্য এবিজি-র মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রিপ্লে সংস্থার অতি ঘনিষ্ঠ)। নতুন অছি পরিষদ অবশ্য তখনই এবিজি-কে হলদিয়া থেকে সরাতে পারেনি। তবে শুভেন্দুবাবুর নেত্ৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের ক্রমাগত হুমকি ও আন্দোলনে তাঁরা জেরবার হয়ে পড়েন বলে এবিজি-কর্তৃপক্ষের অভিযোগ।
আর শেষ পর্যন্ত ওই ‘জঙ্গি আন্দোলনের’ জেরেই তাঁদের হলদিয়া ছাড়তে হল। কিন্তু এবিজি চলে গেলে শুভেন্দুবাবুর কী লাভ?
দু’দিন আগে তৃণমূল সাংসদ নিজেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। গ্লোবাল টেন্ডারে সবচেয়ে কম দর দিয়ে এবিজি ২০০৯-এ হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসের বরাত পেয়েছিল। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দর হেঁকেছিল এবিজি’র মূল প্রতিযোগী রিপ্লের এক সহযোগী সংস্থা। রিপ্লের অন্যতম মালিক আবার তৃণমূলের রাজ্যসভা-সদস্য। গত মঙ্গলবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে শুভেন্দুবাবু এবিজি-র অবর্তমানে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দর দিয়েছে যারা, তাদের কাজের বরাত দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তা না-হলে নতুন করে টেন্ডার ডাকার কথা বলেছেন। উল্লেখ্য, এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত নতুন টেন্ডার ডেকেই কাজের বরাত দেওয়ার নিয়ম।
এ হেন বক্তব্যের ব্যাখ্যা কী?
শুভেন্দুবাবু নিজে এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। বৃহস্পতিবার তাঁকে ফোন করা হলে শুধু বলেছেন, “নো কমেন্টস।” এবিজি-র সিইও গুরপ্রীত মালহি অবশ্য বলেন, “আমরা তো গোড়া থেকেই এই অভিযোগ করে আসছি। প্রথম থেকে বলছি, একটা স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের হলদিয়ায় কাজ করতে দিচ্ছে না।”
এবিজি-সূত্রের খবর: হলদিয়ায় জল ঘোলার পিছনে যে তৃণমূল আইএনটিইউসি’র ভূমিকা রয়েছে, কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান মনীশ জৈনও চিঠি লিখে তা জানিয়েছিলেন খোদ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিবকে।
হলদিয়ায় এবিজি-র কর্মরত শ্রমিকদের একাংশও এ দিন তাঁদের সিইও-র অভিযোগে গলা মিলিয়ে দাবি করেছেন, এবিজি’কে হলদিয়া-ছাড়া করার পরিকল্পনা বহু দিনের। তাঁদের অভিযোগ: ২০১০-এ এবিজি এখানে আসার সময়ই শুভেন্দুবাবু চূড়ান্ত বিরোধিতা করেছিলেন। ওই বছর মার্চে এক জনসভায় প্রকাশ্যে তিনি এবিজি’কে তাড়ানোর কথা বলেছিলেন বলে স্থানীয়-সূত্রের খবর। তৃণমূলের নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া কী?
এ প্রসঙ্গে সরকারি ভাবে তৃণমূলের কোনও বক্তব্য জানা না-গেলেও হলদিয়ার তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহার ‘ঘনিষ্ঠ’ নেতা পিন্টু ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “দলের ভাল-মন্দ বুঝে সে দিনও সাংসদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছিলাম। আজও বিরোধিতা করছি। এবিজি চলে যাওয়ায় ভাল হল না।” সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের কথায়, “তৃণমূল বরাবর ধ্বংসের রাজনীতি করে। তখন ওরা ডাম্পার আটকে রেখে এবিজি’র বিরোধিতা করেছিল। আমি নিজে তখন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সব জানিয়েছিলাম।”
তার পরেও তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা নিলেন না কেন? প্রাক্তন সাংসদের যুক্তি, “তখন নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর হয়ে গিয়েছে। আমাদের সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা কিছুটা তো ছিলই।” |
|
|
|
|
|