|
|
|
|
পশ্চিমবঙ্গে যেও না, বলে দেব বন্ধুদেরও |
ভূষণ পাটিল
(এবিজি’র এজিএম, টেকনিক্যাল) |
দেড় বছরের মেয়েটা এখনও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। স্ত্রী স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। দু’মাস আগে ও অনেক উৎসাহ নিয়ে আমার সঙ্গে আমার নতুন কর্মস্থলে গিয়েছিল। আর সেই হলদিয়াতেই
যে অভিজ্ঞতা ওর হল, সে জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
তাই ঠিক করেছি, ভবিষ্যতে কখনও কোনও সময়ে চাকরি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোথাওই যাব না। হলদিয়া তো দূরের কথা। না-খেতে পেয়ে মরব, সে-ও ভি আচ্ছা। তার সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবকেও বলে দেব, ভুলেও পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে যেও না। ওখানে আমার গোটা পরিবারকে যে অবস্থায় পড়তে হল, চাই না অন্যদেরও সে অবস্থা হোক। অপরাধ না-করেও কোনও জায়গা থেকে যে চোরের মতো পালিয়ে আসতে হতে পারে, হলদিয়া যাওয়ার আগে তা জানা ছিল না।
এ বার জানলাম। আর সেই ‘জানা’র জের এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আপাতত বিশাখাপত্তনমে আছি, অজ্ঞাতবাসে। জানি, এখানে কোনও ভয় নেই। তবু ফোন ধরার সাহস হচ্ছে না। স্ত্রীকেও বারণ করে দিয়েছি। কী জানি, কেউ যদি ফের প্রাণে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয়! আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে কথাও বলছি আমার এক সহকর্মীর ফোন থেকে। একটা রাত যে আমাদের জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছে! |
|
আতঙ্কের পাঁচ প্রহর। ১) দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটে ঢুকল দুষ্কৃতীরা ২) মাথায় ধরল বন্দুক ৩) তুলল গাড়িতে
৪) চলল নিগ্রহ ৫) ফিরে এসে স্ত্রী-কন্যা ও দুই সহকর্মীকেও গাড়িতে চাপিয়ে পাচার। অঙ্কন: সুমন চৌধুরী |
মৃত্যুভয় কী, শনিবারের ওই রাতেই তা বোধহয় প্রথম টের পেলাম। দিনের বেলায় অবশ্য কোনও আঁচ পাইনি। বরং রবিবার সকালে হলদিয়া বন্দরে ফের কাজ শুরু হবে বলে একটু উত্তেজিতই ছিলাম। এবিজি’র অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) হিসেবে আমার কিছু বাড়তি দায়িত্ব ছিল। কিন্তু আসার পর থেকে দু’মাস ঠিকমতো কাজ করতে পারিনি। গোলমাল আর ক্রমাগত হুমকিতে সকলে দিশেহারা ছিলাম। তাই ডকে পুলিশ মোতায়েন হওয়ায় আশা করেছিলাম, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। রাতে খেতে বসে স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বললাম এ নিয়ে। তখনও জানি না, সামনে কী অপেক্ষা করছে!
রাত তখন সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা হবে। হঠাৎ এক সঙ্গে অনেকগুলো মোটরবাইকের আওয়াজ। আমাদের শঙ্খিনী আবাসনের ফটকের সামনে। ভাবলাম, পুলিশ এসেছে। পরে বুঝলাম, মোটরসাইকেলগুলো আমাদের হাউজিং ঘিরে চক্কর কাটছে। কে এক জন এসে বলল, ওরা আমার খোঁজ করছে। ভয় পেয়ে গেলাম। ফোন করলাম হলদিয়া টাউন থানায়। থানা বলল, ‘মোবাইল ভ্যান পাঠাচ্ছি, চিন্তা করবেন না।’
দশ মিনিটের মধ্যে সব মোটরবাইক উধাও। কিন্তু পুলিশ-ভ্যান কোথায়?
ভাবলাম, পুলিশ বুঝি অন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বাদে একটা ভ্যানের সাড়া পেলাম। সেটা বাড়ির আশপাশে ঘুরল। একটু পরে পুলিশ উঠে এসে আমাকেই চার্জ করল, ‘কই, কিছু তো নেই! ফালতু ফোন করলেন কেন?’ ততক্ষণে দুই সহকর্মী ক্যাপ্টেন মনপ্রীত জলি আর জগদীশ বেহেরা আমার ফ্ল্যাটে চলে এসেছে। কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভয় কাটল না।
মেয়েটা বার বার কেঁদে উঠছে। ভয় কাটাতে নিজেরা গল্পগুজব শুরু করলাম। ঠিক হল, মনপ্রীত-জগদীশ রাতটা আমার ফ্ল্যাটে থাকবে। শোওয়ার তোড়জোড় করছি, এমন সময়ে ফের হাজির বাইকবাহিনী। এ বার চক্কর নয়, আবাসনের গেট ধরে তুমুল ঝাঁকানি। হুঙ্কার, ‘ভূষণ পাটিল কোথায়? এত সাহস, পুলিশে খবর দিয়েছিস!’ জানলা দিয়ে দেখি, জনা পঞ্চাশ মারমুখী লোক। কারও মাথায় মাঙ্কিক্যাপ, কারও মুখ মাফলারে ঢাকা।
বুঝলাম, বিপদ দোরগোড়ায়।
মেয়ে আর স্ত্রীকে বেডরুমে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিলাম। জলি, জগদীশ আর আমি বসে রইলাম বাইরের ঘরে, ভয়ে কাঁটা হয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ। শেষে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় বেদম ধাক্কা। যেন দরজা ভেঙে ফেলবে! ফেললও। এক দল লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ফ্ল্যাটে। মাঙ্কিক্যাপ পরা এক জন আমাকে চিনিয়ে দিল। এক জন আমার মাথায় ঠেসে ধরল বন্দুক। বলল, ‘চল শালা।’
হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। শুনতে পেলাম, মেয়েটা তারস্বরে কাঁদছে। আমাকে ঠেলে তোলা হল একটা গাড়িতে। গাড়ি ছুটল বন্দরমুখো রাস্তা ধরে। টানা দু’-আড়াই ঘণ্টা ধরে গাড়ির মধ্যে চলল মারধর, সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। বক্তব্য: আমিই নাকি কর্মীদের ছাঁটাই করেছি। তাই আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। হাত জোড় করে বললাম, ‘আমি তো চাকরি-ই করি! কাউকে ছাঁটাই করার ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। আমাকে ছেড়ে দাও।’ ভাবছিলাম, স্ত্রী-মেয়ের মুখ কি আর এ জীবনে দেখতে পাব?
এ ভাবে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ বন্দুকধারী এক জন বলল, ‘চল্, তোকে ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছি। বৌ-বাচ্চাকে নিয়ে সোজা বেরিয়ে যাবি। কখনও হলদিয়া আসবি না। এলে জ্যান্ত ফিরবি না।’ ওরা নিজেরা কেউ কারও নাম ধরে ডাকছিল না! ডাকছিল গালি দিয়ে।
ফিরলাম। হাউজিংয়ের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে বেঁধে রেখে ওরা উপরে চলে গেল। একটু বাদে নেমে এল আমার স্ত্রী, মেয়ে, মনপ্রীত, জগদীশকে সঙ্গে নিয়ে। সবাইকে ওই গাড়িতেই তুলল। এ বার গাড়ি ছুটল এনএইচ-৪১ ধরে। সেই রাস্তা! দু’মাস আগে যে পথ দিয়ে বৌ-বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলাম। ঘণ্টা দেড়েক পরে গাড়ি থামল মেচেদা স্টেশনে। গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাদের তুলে দেওয়া হল হাওড়ামুখী মেচেদা লোকালে। এক টুপিওয়ালা আবার মনে করিয়ে দিল, ‘এই যে যাচ্ছিস, আর এ-মুখো হবি না। যা, ভাগ্। ছেড়ে দিলাম।’
পালিয়ে এলাম। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে প্রথমে দু’-দু’টো মাল্টিন্যাশনালে কাজ করেছি। তার পরে এবিজি। আদতে আমি মুম্বইয়ের ছেলে হলেও সংস্কৃতিপ্রেমী হিসেবে বাংলার প্রতি টান অনুভব করতাম। তাই যে দিন হলদিয়ায় যাওয়ার অর্ডার বেরোল, খুশিই হয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, হোক না নতুন জায়গা, ফ্যামিলি নিয়েই যাব। কিন্তু এখন সব ধারণা উল্টে গিয়েছে। শনিবার রাতের দুঃসহ স্মৃতিটা পুরোপুরি ভুলে যেতে চাই। তাই পশ্চিমবঙ্গে আর পা দেব না। কালীঘাট, দার্জিলিং দেখার ইচ্ছে ছিল। আর দেখার ইচ্ছে নেই। একটা রাতই তো সব কিছু পাল্টে দিল! |
|
|
|
|
|