চার দিকে ঝোপঝাড় ও আবর্জনার স্তূপ। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে চলা দায়। সন্ধ্যা নামলেই গাঢ় অন্ধকার। অন্য সময়ে গ্রামে পা দিলেই গা ছমছম করে। পৈত্রিক ভিটেমাটি ত্যাগ করে অনেক দিন আগেই গ্রাম ছেড়েছেন বাসিন্দারা। কিন্তু তা বলে তো গৃহলক্ষ্মীকে অভুক্ত রাখা যায় না। তাই ফি বছর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় গ্রামে ফিরে আসেন বাসিন্দারা। কুলটির বেনাগ্রামে পুজোর রাত পোহালেই অবশ্য ফের আগের ছবি। বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, এ ভাবে পুজো করার উদ্দেশ্য অবশ্য উৎসব পালন নয়। তা কার্যত প্রশাসনের ‘উদাসীনতার’ প্রতিবাদ।
কুলটি পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এই বেনাগ্রাম। প্রতি বছরের মতো এ বারও লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করতে গ্রামে ফিরেছেন পুরনো বাসিন্দারা। সোমবার বিকেলে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, একমাত্র লক্ষ্মী মন্দিরটি ঝাড়পোঁছ করে রঙ করা চলছে। প্রবীণ বাসিন্দা সুবোধ মাজি জানালেন, ২০০৫ সালে তাঁরা প্রায় ২৫টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “গ্রামে কোনও উন্নয়ন হয়নি। রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই, নিকাশি নেই, পানীয় জল নেই। অথচ আশপাশের এলাকায় সবই আছে। আমরা অনেক বার এ সবের জন্য দাবি জানিয়েছি। কোনও লাভ হয়নি। দিনের পর দিন তো এ ভাবে থাকা যায় না। তাই এক দিন সবাই মিলে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিলাম।” |
পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে গেলেও প্রতি বছর গৃহলক্ষ্মীর টানে ফিরে আসেন বাসিন্দারা। তাঁদেরই এক জন মিতন মাজি বলেন, “এটাই আমার স্বামী-শ্বশুরের আসল ভিটে। বহু কাল এখানে কাটিয়েছি, তা ভুলি কী করে। গৃহলক্ষ্মী তো এখানেই আছেন। কিন্তু জনমানবহীন এই গ্রামে থাকতে না পেরে সব ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছি।” গ্রামের আর এক প্রবীণ বাসিন্দা পীতাম্বর মাজি বলেন, “এই পুজোর মাধ্যমে আমরা নীরব প্রতিবাদ করছি। আমরা চাই পুরসভা গ্রামের উন্নয়নে হাত দিক।”
পুজোর জন্য পুরসভার তরফেই রাস্তার কিছুটা অংশ ও লক্ষ্মী মন্দিরের সামনে লাল মোরাম বিছানো হয়েছে। খানিক ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হয়েছে। বাসিন্দাদের উদ্যোগে জেনারেটর এনে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। শিকড়ের টানে হাজির হয়েছেন প্রায় শ’দেড়েক গ্রামবাসী। সন্ধ্যার মুখে শুরু হল পুজো। বাসিন্দারা জানালেন, পুজো শেষে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। সারা রাত সকলে একসঙ্গে গল্প করে কাটাবেন। ভোরের আলো ফুটলে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরবেন। বছর বছর এ ভাবেই চলছে বেনাগ্রামের লক্ষ্মীপুজো। সন্তোষ মাজি নামে এক বাসিন্দা জানালেন, প্রত্যেক বার পুজোর শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাঁরা ভাবেন, সামনের বছর হয়তো গ্রামের ভিটেমাটিতে বাস করেই লক্ষ্মীপুজো করবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয় না।
বছর তিনেক আগে কুলটি পুরসভার ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল ও কংগ্রেস। কিন্তু বেনাগ্রামের কোনও পরিবর্তন হয়নি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। পুরপ্রধান তথা স্থানীয় বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “ওই গ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনা হয়েছে। দ্রুত তা রূপায়ণ করা হবে।” কত দ্রুত তা হবে, কারও জানা নেই। তত দিন পর্যন্ত বছরে এক রাত গ্রামে কাটানোই ভবিতব্য বাসিন্দাদের। |