ওরা তক্কে তক্কে থাকে। ফাঁক পেলেই যাতে ঢুকে পড়তে পারে মানুষের শরীরে। সাধারণত বড় একটা সুযোগ পায় না। কিন্তু এখন ‘নতুন’ ডেঙ্গির দৌলতে কিছু ক্ষেত্রে মওকাটা পেয়ে যাচ্ছে অন্যান্য রোগ-জীবাণুর দল।
আর মুশকিলে পড়ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, এ বছরের হানাদার ‘তিন নম্বর’ ডেঙ্গি-ভাইরাসটি আক্রান্তের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ায় ডেঙ্গি ‘নিরাময়ের’ মাসখানেক না-কাটতেই কেউ কাহিল হয়ে পড়ছেন নিউমোনিয়ায়, কেউ টাইফয়েডে, কেউ বা পেটের বা গলার সংক্রমণে। কারও হচ্ছে ম্যালেরিয়া। আচমকা হারপিসের শিকার হচ্ছেন অনেকে। কারও রক্তের অনুচক্রিকার (প্লেটলেট) সংখ্যা কিছুতেই ওঠানো যাচ্ছে না। আবার কারও কারও শরীরে ফের সক্রিয় হচ্ছে ডেঙ্গি-ভাইরাস!
সব মিলিয়ে ডেঙ্গি-হামলার প্রাথমিক তীব্রতা কাটার পরেও সঙ্কট সম্পূর্ণ কাটেনি। জুলাই-অগস্টে ডেঙ্গি-হানার সূচনাপর্বে উপসর্গের জটিলতা ডাক্তারদের বেজায় ভুগিয়েছিল। অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকও বুঝতে পারেননি যে, উপসর্গগুলো আদতে ডেঙ্গির! তাই অনেক ক্ষেত্রে আসল চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়েছে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে কিছু রোগীর অবস্থা ঘোরালো হয়ে পড়েছে।
এক পরজীবী-বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “ডেঙ্গি এ বার বিরাট শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। ডাক্তারির পাঠ্যবইয়ে এই রোগের উপসর্গ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটা বোধহয় পুরো বদলে ফেলা দরকার। এখন আমরা কোনও ঝুঁকি নিচ্ছি না। জ্বর, পেট খারাপ, মাথাব্যথা, হঠাৎ কোষ্ঠকাঠিন্য যাই হোক না কেন, রক্ত পরীক্ষা করাতে বলছি। কিছুই আর হেলাফেলার নয়।”
শুরুতে যেমন ভুগিয়েছিল, মাঝপথে এসেও ডেঙ্গি সমস্যায় ফেলেছে চিকিৎসক, গবেষকদের। রোগ ধরা পড়ার পরে চিকিৎসা চলছে নিয়ম মেনে, তবু বহু রোগী যেন কিছুতেই পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছেন না! ডেঙ্গি হয়তো সারছে, কিন্তু বিধ্বস্ত শরীরে চড়াও হচ্ছে অন্য সংক্রমণ। দুর্বল শরীর তার কাছে আত্মসমর্পণ করছে। |
ফলে এক জন ডেঙ্গি রোগীর সাধারণত যে সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার কথা, তার মেয়াদ বিস্তর বেড়ে যাচ্ছে।
ডেঙ্গি সংক্রমণের এ হেন ‘পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার’ পিছনে নতুন ভাইরাসটির চারিত্রিক বৈশিষ্টকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। যেমন বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর অধিকর্তা, ভাইরোলজিস্ট শেখর চক্রবর্তী বলেন, “এ বারের ডেং-থ্রি ভাইরাস আগেরগুলোর চেয়ে আলাদা। সংক্রমণের তীব্রতা দেখেই আমাদের সন্দেহটা হয়েছিল। এখন রোগ যখন কিছুটা
থিতিয়ে এসেছে, তখন ভাইরাসের অন্যান্য চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।” কী রকম?
প্লেটলেট’কে দাবিয়ে রাখা ডেং-৩ ভাইরাসের ‘স্বতন্ত্রতা’র অন্যতম নিদর্শন বলে শেখরবাবুর দাবি। তাঁর কথায়, “ভাইরাসটি মানুষের শরীরে এমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে, যাতে নেমে যাওয়া প্লেটলেটস সহজে বাড়ছে না। বহু দিন ধরে তা একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ডেং-থ্রি নিয়ে আরও গবেষণা দরকার। নচেৎ তাকে বাগে আনা যাবে না।”
পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর কথাতেও একই সুর। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওই প্রাক্তন অধিকর্তা গত তিন মাসে অন্তত শ’দুয়েক ডেঙ্গি-রোগীর চিকিৎসা করেছেন। এবং এখন তিনি বলছেন, “এই ডেঙ্গি ভীষণ দুর্বল করে দিচ্ছে রোগীকে। প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ায় অন্যান্য জীবাণু চট করে কাহিল করে ফেলছে। কেউ কেউ ডেঙ্গি সেরে যাওয়ার দু’-তিন সপ্তাহ পরে ফিরে আসছেন। দেখছি, কারও ম্যালেরিয়া হয়েছে, কারও নিউমোনিয়া বা টাইফয়েড। কারও আবার ডেঙ্গির অ্যান্টিবডি পজিটিভ!”
অর্থাৎ, ডেঙ্গির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না-উঠতেই পরে ফের অন্য সংক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছেন কিছু লোক। চিকিৎসকদের অনেকে জানাচ্ছেন, এ বারের ডেঙ্গির উপসর্গ অনেক ক্ষেত্রে বইয়ে লেখা উপসর্গের সঙ্গে না-মেলায় উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি বেড়েছে। অমিতাভবাবু বলেন, “তেমন মারাত্মক উপসর্গ না-থাকলেও কারও হয়তো আচমকা প্লেটলেটস নেমেছে হুড়হুড়িয়ে। সঙ্গে রক্তপাত। তখন সামাল সামাল রব উঠেছে।”
২০১২-র ডেঙ্গির আরও ‘বিশেষত্ব’ ধরা পড়েছে। শহরের বেশ কিছু ডাক্তার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, ডেঙ্গি এক বার সেরে যাওয়ার পরে অনেকের যেমন ম্যালেরিয়া-টাইফয়েড নিউমোনিয়া হচ্ছে, তেমন কেউ কেউ দু’-তিন সপ্তাহ বাদে আবার ডেঙ্গিতেই আক্রান্ত হচ্ছেন! কিন্তু ডেঙ্গির জীবাণু এক বার ঢুকলে তো শরীরে তার প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা! তা হলে ফের সংক্রমণ কেন?
শেখরবাবুর ব্যাখ্যা, “ডেঙ্গির একই গোত্রের জীবাণু পরের পর আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বারে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ, শরীরে ওই গোত্রের ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। শুধু অন্য গোত্রের ডেঙ্গি-ভাইরাস এলে দ্বিতীয় বার সংক্রমণ হওয়া সম্ভব।” শেখরবাবুর মতে, দ্বিতীয় বার যাঁরা ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করলেই রহস্যটা পরিষ্কার হবে।
ডেঙ্গির প্রত্যাবর্তনের অন্য ব্যাখ্যাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি: কিছু রোগী পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই ডাক্তার তাঁদের ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা যথারীতি কাজে যাচ্ছেন। সেই ধকল শরীর নিতে পারছে না। চলে যেতে যেতেও তাই ডেঙ্গি ফের গেড়ে বসছে ওঁদের শরীরে। এমন ‘চিকিৎসা বিভ্রাটের’ কথা মানছেন অমিতাভবাবুও। “এক রোগীর জ্বর কমে গিয়েছিল, প্লেটলেটও উঠে গিয়েছিল লাখের উপরে। ডাক্তার ফিট সার্টিফিকেট দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেখা গেল, পিঠে জল জমে গিয়েছে। যে জন্য হাসপাতালেই ওঁর বিছানায় বসতে কষ্ট হচ্ছিল। এটা ডেঙ্গি-জটিলতার লক্ষণ। অথচ ডাক্তারের নজর এড়িয়ে গিয়েছে!” বলেন তিনি।
ব্যাখ্যা যা-ই হোক, ডেঙ্গি-উত্তর সংক্রমণই আপাতত নতুন বিপদ মহানগরে। |