নোটে নোটে লেনদেন লাখো লাখো জীবাণুর
খন মাইনে হত নগদে। এখনকার মতো সংখ্যা হয়ে ব্যাঙ্কে জমা পড়ত না। মাইনে হলেই টাকাগুলো নিয়ে ভদ্রলোক যেতেন বেসিনে। একটা একটা করে নোট মুছতেন ভেজা হাতে। তার পর আলতো করে নোটগুলো জামার পকেটে রেখে, হাত ধুতেন বেশ খানিক ক্ষণ ধরে। সব শেষে হাত দু’টো আলগা করে তুলে ধরে (পাছে কোথাও ছোঁয়া লাগে) সতর্ক ভাবে ফিরে আসতেন নিজের টেবিলে। কলটা বন্ধ করে দিয়ে আসতে হত অন্য কাউকে।
জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক বলতেন, “কত হাতে ঘুরে আসে। কত কিছু লেগে থাকে। তাই একটু.... ।” মুখ টিপে হাসতেন অফিসের সবাই। বলতেন বাতিকগ্রস্ত।
হয়তো কিছুটা বাড়াবাড়িই করতেন ভদ্রলোক। তাঁর উদ্বেগটাকে কিন্তু মোটেই অমূলক বলতে পারছে না ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা। টাকায় লেগে থাকা ময়লায় যে রোগের জীবাণু থাকতে পারে, সেটা অজানা কিছু নয়। কিন্তু তা কতটা বিপজ্জনক, তারই অনুসন্ধানে নেমেছিলেন তিন বিজ্ঞানী, ই কে ইলুমালাই, আর্নেস্ট ডেভিড এবং জে হেমচন্দ্রন। গত ফেব্রুয়ারিতে তামিলনাড়ুর ভেল্লোরে কয়েক জন বাস কন্ডাক্টর, মাছ ও সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে ৫ ও ১০ টাকার বেশ কিছু নোট সংগ্রহ করেন তাঁরা। সেগুলি রাখা হয় বায়ুনিরোধক পরিষ্কার কৌটৌয়। এর পর গবেষণাগারে পরীক্ষা করে তাঁরা দেখেন, বারবার হাতবদলের ফাঁকে নোটগুলিতে ‘বাসা বেঁধেছে’ হরেক কিসিমের জীবাণু। সংক্রামক কয়েকটি রোগের ব্যাক্টেরিয়াও। যেগুলি থেকে সংক্রমণ হতে পারে ত্বকে, নানা অসুখ ছড়াতে পারে শ্বাসযন্ত্র ও পাকযন্ত্রে। হতে পারে খাদ্যে বিষক্রিয়া। এমনকী মেনিনজাইটিস, সেপটিসেমিয়ার মতো জটিল রোগও। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন’ পত্রিকার অক্টোবর মাসের সংস্করণে প্রকাশিত হতে চলেছে এই গবেষণাপত্র।
নগদে ফাউ
খাদ্যে বিষক্রিয়া সর্দিকাশি
ত্বক, শ্বাসনালি, পাকযন্ত্র,
কিডনি ও রেচননালিতে সংক্রমণ
মেনিনজাইটিস সেপটিসেমিয়া
পাঁচ প্রতিরোধ
ব্যাঙ্কে অতিবেগুনি রশ্মি বা রাসায়নিক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা

থুতু দিয়ে টাকা না গোনা

টাকা পরিষ্কার জায়গায় রাখা

পরিচ্ছন্ন হাতে লেনদেন করা

সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কার্ডে কেনাকাটা
গবেষক দলটির অন্যতম সদস্য ভেল্লোরের থিরুভাল্লুভার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আর্নেস্ট ডেভিড আনন্দবাজারকে জানান, “টাকায় যে বিভিন্ন রোগজীবাণু থাকে, সে ব্যাপারে সকলে সচেতন নন। নোট গোনার সময় অনেকেই আঙুল ভিজিয়ে নেন জিভের লালায়। রাস্তাঘাটে খাবার কিনে খাওয়ার ক্ষেত্রেও একই বিপদ। হাতে কোনও ক্ষত থাকলে তা দিয়েও নোটের জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়তে পারে।” তাঁর কথায়, “দোকান-বাজার থেকে পাঁচতারা হোটেল সর্বত্র অবাধ বিচরণ টাকার। সময়ে-সময়ে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছয় সেগুলি। এতে সহজেই এক জনের থেকে অন্য জনের শরীরে রোগজীবাণু ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।” তবে গবেষকরা এ-ও জানিয়েছেন, পরিচ্ছন্নতার সহজ কিছু নিয়ম মানলেই নোটে থাকা জীবাণুর হানা ‘ঠেকানো’ সম্ভব।
সম্ভাব্য ক্ষেত্রে স্মার্ট কার্ডে লেনদেন করলেও এই বিপদ খানিকটা কমে আসে বলে মনে করিয়ে দিলেন কলকাতার একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এক উচ্চপদস্থ কর্মী। এই প্রসঙ্গে শোনালেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথাও, “ভল্টে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে লক্ষ-লক্ষ নোট গোনার সময় রীতিমতো ধুলোর মেঘ জমে যায়। আপ্রন পরে, নাক-মুখ মুখোশে ঢেকে ঢুকতে হয়।”
কলকাতার একটি হাসপাতালের এক ভাইরাস বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, টাকা কিছুটা পুরনো হলে ধুলো জমে সেগুলি কালচে হয়ে যেতে থাকে। প্রচুর ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসও নোটগুলির উপর লেগে থাকে। এ দেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় টাকার নোটেও কিছুটা জলীয় বাষ্প জমে থাকে। তা ওই জীবাণুগুলিকে নোটের উপর টিকে থাকতে সাহায্য করে। ওই ভাইরোলজিস্টের কথায়, “অপরিচ্ছন্ন ঘিঞ্জি এলাকায়, বাজারের নোটে ব্যাক্টেরিয়া বেশি থাকে। সর্দি-কাশি থাকলে সেই ব্যক্তির কাছে থাকা নোটেও তার রোগের জীবাণুর হদিশ মিলতে পারে। ফলে নোটের মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা অমূলক নয়।”
গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর বক্তব্য, “এই গবেষণা স্বাভাবিক ভাবেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আমাদের চার পাশে সব সময়ই অগণিত ব্যাক্টেরিয়া ছড়িয়ে থাকে। তাদের বলা হয় এনভায়রনমেন্টাল প্যাথোজেন (পরিবেশগত রোগ-কারক)। মানবদেহে সেগুলি ক্রমাগত প্রবেশ করতে থাকে। তবে তাতে কেউ রোগাক্রান্ত হবেন কি না, সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির শারীরিক পরিস্থিতি এবং ব্যাক্টেরিয়ার জিনগত বৈশিষ্ট্যের উপর।”
গবেষকদলটির সদস্য ডেভিড জানাচ্ছেন, নমুনা হিসেবে যে নোটগুলি নেওয়া হয়েছিল, তার সব ক’টিতেই রোগজীবাণু মিলেছে। পুরনোগুলিতে তো বটেই নতুন নোটেও কমপক্ষে ৮ রকমের ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া গিয়েছে। যেমন, এসচেরিচিয়া কোলাই, প্রোটিয়াস মিরাবিলিস, স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস এবং সালমোনেল্লা, ব্যাসিলাস, সিউডোমোনাস, ভিব্রিও প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া। অর্থাৎ টাকার নোটগুলিও এক রকমের ‘ভেক্টর’ (রোগজীবাণু যার মাধ্যমে ছড়ায় তাকে ভেক্টর বলে। যেমন ডেঙ্গির মশা)। চিকিৎসক অভিজিৎবাবু জানিয়েছেন, বিশেষ ক্ষেত্রে ওই সব ব্যাক্টেরিয়া মানবদেহে ত্বক, খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, রেচননালীর বিভিন্ন অংশে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম।
নোটগুলি জীবাণুমুক্ত করার কয়েকটি উপায়ও বাতলেছেন গবেষকরা। তাঁরা বলেছেন, ব্যাঙ্কে নোট পৌঁছলে অতিবেগুনি রশ্মি দিয়ে বা কোনও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সে গুলিকে জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া সম্ভব। ডেভিড বলেন, “কিছুটা সতর্ক হলেই ওই সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায়। টাকা লেনদেন ও রাস্তাঘাটে খাওয়ার সময় এ কথা মনে রাখাটা খুব জরুরি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.