অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র? নেই। আগুন লাগলে জল নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জলাধার? তা-ও নেই। একটি পাতকুয়ো অবশ্য আছে। সেটিকে কেউ বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে আগুন নেভানোর জলাধার মনে করলে অবশ্য আলাদা কথা।
বড় ধরনের আগুন লাগলে বিপন্ন মানুষ যাতে দ্রুত বেরোতে পারেন, সে জন্য প্রশস্ত পথ চাই। কিন্তু শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের তিনতলা একটি ভবনের সামনে মূল প্রবেশপথটি ইটের দেওয়াল তুলে আটকে দেওয়া হয়েছে। রোগী ও রোগীর পরিজনেরা যাতায়াত করছেন ওই ভবনের পিছন দিকে সরু রাস্তা দিয়ে।
চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের একতলায় রোগীর আত্মীয়দের অপেক্ষার জন্য তৈরি বিশাল হলঘরের তিন দিকে ডাঁই করা বাতিল বিভিন্ন জিনিসপত্র, যেগুলির প্রায় সবই দাহ্য বা অতি দাহ্য।
কেউ উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত হতেই পারেন। রাজ্য সরকার কিন্তু সন্তুষ্ট!
২০১১-এর ৯ ডিসেম্বর আমরি-অগ্নিকাণ্ডে ৯২ জনের মৃত্যুর পরে প্রায় ১০ মাস ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল-নার্সিংহোমে অভিযান চালিয়েছিল দমকল। দফায় দফায় বৈঠকও হয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান মহাকরণে ঘটা করে জানিয়েছিলেন, হাসপাতালগুলি যে-ভাবে অগ্নিবিধি মেনে চলছে, তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট। কিন্তু সেই আমরি-কাণ্ডকেই ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাস্থ্য দফতরের পূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে তাঁরই হাতে। |
চিত্তররঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের বহির্বিভাগের
প্রতীক্ষালয়ে ডাঁই করে রাখা দাহ্য পদার্থ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক |
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে হাঁটা পথে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন। সেখানে প্রসূতিদের ‘জরুরি ভবনে’ নেই অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র। হাসপাতালের ‘গোয়েন্কা বিল্ডিংয়ে’ সিঁড়ি একটি। দোতলা ভবন ‘বিড়লা ব্লকেও’ একটি মাত্র সিঁড়ি। গত জানুয়ারিতে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে দমকল দু’টি বাড়িতেই আরও একটি করে সিঁড়ি তৈরির সুপারিশ করে। সিঁড়ি না তৈরি হওয়ার পাশাপাশি দমকলের নির্দেশিকা মেনে হচ্ছে না আগুন নেভানোর মহড়াও।
হাসপাতালের সহকারী সুপার অমিত হাজরা বলেন, “প্রায় ৭০ বছরের পুরনো বাড়িগুলি ভেঙে আর একটি সিঁড়ির জন্য বাড়তি জায়গা বার করা মুশকিল। ‘গোয়েন্কা বিল্ডিং’ মূলত প্রশাসনিক ভবন। ঠিক হয়েছে, ওখানে একটি লোহার ঘোরানো সিঁড়ি হবে। ‘বিড়লা ব্লকে’ হবে ঢালাই সিঁড়ি। এগুলি করার দায়িত্ব পূর্ত দফতরের।” পূর্ত দফতরের এক ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “সম্প্রতি বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। কাজ শুরু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
চিত্তরঞ্জন সেবা সদন সংলগ্ন, কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের ছবিটাও প্রায় এক। দু’টি ভবনে আপৎকালীন রাস্তা নেই। হাসপাতালের অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাস বলেন, “দু’টি ভবনই বহু পুরনো। দমকলের সুপারিশ রূপায়ণ করতে সময় লাগবে। একতলায় রোগীর আত্মীয়েরা যে ঘরে অপেক্ষা করেন, সেখানে প্রচুর দাহ্য বস্তু ডাঁই করা। আচমকা আগুন লাগলে বড় বিপদ হবে, সে কথা ঠিক। আসলে জিনিসগুলি রাখার জন্য প্রয়োজনীয় গুদাম নেই।”
এসএসকেএম-এর পেল্লায় রেডিওলজি বিভাগের মূল প্রবেশপথের কোল্যাপসিব্ল গেটটি দীর্ঘদিন তালাবন্ধ। একটিও অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র নেই গোটা চত্বরে। প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগেও নেই আগুন নেভানোর ন্যূনতম ব্যবস্থা। সুপার তমাল ঘোষ বলেন, “আমি এপ্রিলের শেষে দায়িত্ব নিয়েছি। দমকল অনেক কিছু বলে গিয়েছে। পূর্ত দফতরের সঙ্গে কথা বলে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে দরপত্র নেওয়া হয়েছে।” |
এসএসকেএম-এর রেডিওলজি বিভাগের মূল
প্রবেশপথের তালাবন্ধ কোল্যাপসিব্ল গেট। —নিজস্ব চিত্র |
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেন ব্লকে ‘ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেব্ল ডিজিজেস’ এবং মেডিসিন বিভাগের দেওয়ালে গুটিকতক অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র আটকানো। সেগুলিতে শেষ কবে গ্যাস ভরা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। ক্যাজুয়ালটি বিভাগ, ইডেন হাসপাতাল কোনও ভবনেই নেই স্মোক অ্যালার্ম বা ফায়ার অ্যালার্ম। কেন? হাসপাতালের অধ্যক্ষ উৎপল দত্ত বলেন, “আমি কোনও মন্তব্য করব না। উপরমহলে জিজ্ঞাসা করুন।”
আরজিকর হাসপাতালের তিন তলায় সার্জারি ভবনে হাতে গোনা কিছু ‘ফায়ার শিল্ড’। কবেকার, কেউ জানে না। ২০০৮-এর ৭ জানুয়ারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হাসপাতালের প্ল্যাটিনাম জুবিলি ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন। এখনও ঝাঁ-চকচকে ওই ভবনে ‘ফায়ার হোস রিলের’ কাঁচের খাঁচা ঝুলে ঢাকা। হাসপাতালের সুপার স্বপন সাঁতরা বলেন, “ভবনগুলি পুরনো। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে সতর্কতার ব্যবস্থা করতে প্রচুর টাকা দরকার। দেখি কী করা যায়।”
বাঘা যতীন সরকারি হাসপাতালে জলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা থেকে অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র, নিরাপদ বিদ্যুৎ সংযোগ যে সব আপৎকালীন ব্যবস্থা নিতে দমকল নির্দেশ দিয়েছিল, তার প্রায় কিছুই করা হয়নি। সুপার রঞ্জন মজুমদার বলেন, “সম্ভবত অর্থাভাবেই এ কাজগুলি করা যায়নি।”
আগুনের সঙ্গে যুঝতে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। বিভিন্ন ভবন ঘুরে দেখা মিলবে দু’চারটি অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের। সেগুলিও পুরনো, মেয়াদ-উত্তীর্ণ। হাসপাতালের সুপার সৌমাভ দত্ত বলেন, “আমি এপ্রিলে দায়িত্ব নিয়েছি। দমকলের সুপারিশগুলি পূর্ত দফতর খতিয়ে দেখছে। নতুন কিছু অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র কিনতে হবে। পুরনোগুলোরও রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। এ ব্যাপারে খরচের হিসেব স্বাস্থ্য ভবনে পাঠিয়েছি।”
আমরি-কাণ্ডের ঠিক পরেই দমকলকর্তারা বেহালা বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে প্রায় কিছুই নেই। জরুরি ভিত্তিতে দমকলের নির্দেশ সত্ত্বেও তৈরি হয়নি দ্বিতীয় সিঁড়ি, জলাধার। হাসপাতালের সম্পাদক মিলন সেনগুপ্ত বলেন, “কাজ যে কিছুই হয়নি, এমন নয়। দমকলের নির্দেশ মেনে কয়েকটি অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র কেনা হয়েছে।”
দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পূর্ত দফতর সরকারি হাসপাতালগুলির কাজ করে। তাই সময় লাগছে।” |