অঙ্গনওয়াড়ির হেঁশেল চলছে ‘ম্যানেজ’ করে
৫০ জনের সব্জি কি ২৩ টাকায় হয়, প্রশ্ন কর্মীদের
কেটে কুচোমাছ কেনারও টাকা নেই। কিন্তু, বাজার থেকে আনতে বলা হচ্ছে পাকা রুই।
ফল যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে।
এ রাজ্যের গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লক্ষাধিক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের হেঁশেল চালাতে গিয়ে ঘোর সমস্যায় পড়েছেন কর্মীরা। ভাত-ডাল-সব্জি বা ডিমের ঝোলের বদলে মা ও শিশুকে ট্যালট্যালে খিচুড়ি খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মীরা। তাঁদের কথায়, “এক জন পূর্ণবয়স্ক মহিলার জন্য রোজ ২২ থেকে ২৩ পয়সা সব্জি বাবদ বরাদ্দ। সারা বাজার ঘুরেও ৫০ জন মা-শিশুর জন্য প্রতিদিন ২৩ টাকার মধ্যে সব্জি জোগাড় করে দেওয়া সম্ভব? সঙ্গে রয়েছে হলুদ-পাঁচফোড়ন কেনার খরচ। হাটে-বাজারে, মুদির দোকানে খোঁটা শুনেও মুখ বুজে থাকতে হচ্ছে। কারণ, তর্ক করলেই দোকানি মাল দেওয়া বন্ধ করে দেবে।”
তা-ও ভাল অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে এখনও রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার হয় না। পুরুলিয়া শহরের কাছে একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মীর মন্তব্য, “নইলে আর রক্ষা ছিল না! পাততাড়ি গুটিয়ে কবে চলে যেতে হত!”
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির হেঁশেলে হাঁড়ির হালের পিছনে রয়েছে অর্থনীতির সহজ হিসাব। কাপড় যতটা, তা দিয়ে হয় বড়জোড় কৌপীন। কোট বানাতে গেলে চলবে কী করে? আগুন বাজারে কেন্দ্রীয় সরকার যা বরাদ্দ করেছে, তাতে আর যাই হোক, মা আর বাচ্চাকে একবেলা পেটভরে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। কম বরাদ্দ নিয়ে কাটছাঁট করে চালাতে গিয়ে সরাসরি পুষ্টিতেই কোপ পড়ছে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের (আইসিডিএস) রান্নাঘরে।
প্রতিদিন মাথাপিছু বরাদ্দ
শিশু ৪ টাকা
চরম অপুষ্ট শিশু ৬ টাকা
প্রসূতি ও গর্ভবতী ৫ টাকা

মরসুমি সব্জি
শিশুদের জন্য ২৪ পয়সা
মায়েদের জন্য ২২.৫ পয়সা
ডিমের জন্য ১ টাকা ৮০ পয়সা (অর্ধেক ডিম ধরে)
সয়াবিন ১০ পয়সা

কোন বাজারে পাবেন
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ছ’মাস থেকে ছ’বছর পর্যন্ত শিশুদের এই কেন্দ্রগুলি থেকে রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। পাশাপাশি গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরাও খাবার পান। গর্ভবতী ও প্রসূতিদের জন্য প্রতিদিন মাথা পিছু চাল বরাদ্দ ৭৫ গ্রাম, শিশুদের জন্য ৫০ গ্রাম। ডাল প্রতিদিন মায়েদের জন্য মাথাপিছু ২৫ গ্রাম, শিশুদের জন্য ১৫ গ্রাম। মরসুমি সব্জি গর্ভবতী ও প্রসূতিদের জন্য প্রতিদিন সাড়ে ২২ পয়সার, শিশুদের জন্য ২৪ পয়সার। সয়াবিন এবং ডিমের বরাদ্দ প্রতিদিন মাথাপিছু যথাক্রমে ১০ পয়সা এবং ১ টাকা ৮০ পয়সা করে। চরম অপুষ্ট শিশুদের জন্য বরাদ্দ সামান্য বেশি।
এ তো গেল কাঁচা আনাজ। এ বার তাকানো যাক জ্বালানি বাবদ বরাদ্দের দিকে। এ ক্ষেত্রে মোট ৫০ জনের কম লোকের জন্য জন্য রান্না হলে প্রতিদিন ১৪ টাকা, ৫০ জনের ক্ষেত্রে ১৭ টাকা, ৫১ থেকে ৭০ জন মা-শিশুর জন্য হাঁড়ি চড়লে ১৯ টাকা। এই সংখ্যা ৭০ এর বেশি হলে জ্বালানি বাবদ মিলবে ২১ টাকা।
বাজার কী বলছে?
বলছে, এক জোড়া ডিম এখন ৮ থেকে ৯ টাকা। সব্জি এমনিতেই অগ্নিমূল্য। সাধারণ আলু (জ্যোতি) অনেক দিন হল ১৪-১৫ টাকা কেজি। সয়াবিনের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
অথচ সব মিলিয়ে প্রসূতি ও গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুদের জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্রই ৪ থেকে ৫ টাকা। খোলাবাজার থেকে তাই জিনিস জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। তাঁরা বলছেন, “হিসাবে জল মেশানো বা ম্যানেজ করা ছাড়া পথ নেই। কখনও ধার-দেনা করে, কখনও বা অনুপস্থিত শিশুদের উপস্থিত দেখিয়ে হিসাবে গোঁজামিল করে রান্না করতে হচ্ছে।”
ম্যানেজ করে রান্না চালাও রাজ্যের ১,১২,৪৩২টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কাজ চলছে এই নীরব স্লোগানে ভর করেই।
একটি কেন্দ্রে এক জন কর্মী ও এক জন সহায়িকা থাকেন। কর্মীদের মাসিক ভাতা ৪৩৫০ টাকা (েকন্দ্র দেয় ৩০০০ টাকা)। আর সহায়িকারা পান ২৮৫০ টাকা (কেন্দ্রের ১৫০০ টাকা)। দু’টি ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার ১৩৫০ টাকা করে সাম্মানিক ভাতা দেয়।
রাজ্যের শিশুকল্যাণমন্ত্রী শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের জেলা বাঁকুড়ার ছবিটাও আলাদা নয়। সেখানকার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ক্ষোভ, সমস্যাটি নিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া থেকে শুরু করে বিক্ষোভ-আন্দোলনকিছুই বাদ রাখেননি তাঁরা। সুরাহা হয়নি। জেলার এক আইসিডিএস কর্মী বলেন, “সরকারি বরাদ্দে আর চলছে না। মাঝেমধ্যেই বেতনের কিছু টাকাখরচ করতে হয় জিনিসপত্র কিনতে। উপায় কী? মা আর বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারলে এলাকার লোক কি ছেড়ে কথা বলবে?”
এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি জোগাড়ের হ্যাপা। কর্মীরা জানিয়েছেন, ৫০ জনের রান্না করতে অন্তত ৮ কেজি কাঠ লাগে। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া বা উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় ছাঁট কাঠ তা-ও তিন টাকা কেজি দরে মেলে। হাওড়া-হুগলি বা দুই ২৪ পরগনায় কাঠের দাম বেশি। ফলে একবারই কোনও মতে খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। চাল-ডাল-সব্জি আলাদা করে রান্নার উপায় নেই। অত জ্বালানি আসবে কোথা থেকে?
ভাঙা পায়ে বাটখারা পড়ার মতো সম্প্রতি কেন্দ্রের একটি নির্দেশ এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, খিচুড়ির পরিবর্তে ভাত-ডাল-সব্জি অথবা ডিমের ঝোল-ভাত খাওয়াতেই হবে মা ও শিশুদের। বীরভূমের রাজনগর ব্লকের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কথায়, “এ জন্য দিনে অন্তত তিন বার রান্না করতে হবে। কিন্তু, জ্বালানি খাতে যা বরাদ্দ, তাতে কোনও ভাবেই তা সম্ভব নয়। এত বাসনই বা কোথায়?”
এত সমস্যার মধ্যেও জ্বালানির বরাদ্দ কিছুটা বাঁচিয়েই হলুদ ও মশলা কিনতে হচ্ছে অনেক জেলার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। বহু কেন্দ্রেই অর্ধেক করে ডিম দেওয়া হচ্ছে। তাতে গ্রামবাসীর সঙ্গে নিত্য ঝামেলা বাধছে কর্মীদের। পুরুলিয়ার কাশীপুরের বাসিন্দা স্বপন চৌধুরী বলেন, “গত দেড় মাস বিভিন্ন কেন্দ্রে শিশুর ও মায়েদের জন্য ডিম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন জানতে চাওয়ায় কর্মীদের কাছে সদুত্তর মেলেনি।” ওই জেলারই জয়পুরের বাসিন্দা পিন্টু মোদকের কথায়, “এখানে যতগুলি কেন্দ্রে খবর নিয়েছি, ডিম এখন সপ্তাহে একদিন বা কোথাও দু’দিনে ঠেকেছে। তা-ও অর্ধেক করে দেওয়া হয়।”
আর কর্মীরা বলছেন, “অভিযোগ শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। এর উপরে রয়েছে বাচ্চাদের পড়ানো, রান্নার দেখভাল করা, বাজার আনা আরও কত কী!” ঝামেলার আঁচ পাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনও। পুঞ্চা ব্লকের সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প আধিকারিক সুভাষ মাহাতো বলেন, “কর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।” জঙ্গলমহলের এক ব্লকের প্রকল্প আধিকারিক বললেন, “যখন কেন্দ্রগুলিতে পরিদর্শনে যাই কর্মীরা জানতে চান, এই পয়সায় কী করে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া যাবে। কী উত্তর দেব, বুঝতে পারি না।”
সম্প্রতি পুরুলিয়ায় অনুষ্ঠিত রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতির সম্মেলনে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীও বলেছেন, “বরাদ্দ বাড়েনি। অথচ জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। মা-শিশুরা তাই পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না।”
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় শিশুকল্যাণ দফতরের সচিবের সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে তুলেছিলেন বিভিন্ন জেলার আইসিডিএস প্রকল্প আধিকারিকেরা। আশু সমাধান অবশ্য মেলেনি। শিশুকল্যাণ মন্ত্রী বলেছেন, “আমরা শীঘ্রই কেন্দ্রের কাছে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য চিঠি দিচ্ছি।”
কেন্দ্র বরাদ্দ বাড়াবে কি না, এখন তার উপরেই নির্ভর করছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির হেঁশেল। ততদিন ভরসা ‘জয় বাবা খিচুড়িনাথ’!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.