খাদ্য ভাণ্ডারে এখনও জমে আছে গত বছরের তিন লক্ষ টন চাল।
কিন্তু টাকার ভাঁড়ার তলানিতে।
তবু ধারের টাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চাল সংগ্রহে নামছে রাজ্য সরকার।
প্রয়োজন প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন চাল। কিন্তু তার চেয়ে বেশি চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে রাজ্য মন্ত্রিসভার খাদ্য বিষয়ক কমিটি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কমিটির ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সভাপতিত্ব করেন। বাড়তি চাল সংগ্রহ করতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হবে। টানাটানির সংসারে তাদের পক্ষে ওই টাকা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে অর্থ দফতর। বাধ্য হয়ে টাকার সন্ধানে নাবার্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল রাজ্য। তারা প্রথম ধাপে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। তবে ১০ শতাংশ সুদের বিনিময়ে।
গত আর্থিক বছরের তুলনায় কত বেশি চাল কিনছে রাজ্য?
খাদ্য দফতরের খবর, ২০১১-’১২ সালে রাজ্যে লক্ষ্যমাত্রা (২০ লক্ষ মেট্রিক টন)-র চেয়ে ৫০ হাজার মেট্রিক টন বেশি চাল সংগৃহীত হয়েছিল। অর্থাৎ সংগৃহীত হয়েছিল মোট ২০.৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল। তারই তিন লক্ষ এখনও পড়ে আছে বিভিন্ন গুদামে। চলতি ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ২২.৫ লক্ষ মেট্রিক টন। গত বছরের লক্ষ্যমাত্রার থেকে আড়াই লক্ষ টন বেশি।
প্রশ্ন উঠেছে, গত বছরের চালই পড়ে আছে। তা হলে এ বার বাড়তি চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে কেন?
প্রশ্ন উঠেছে, প্রয়োজন না-থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত চাল কেনার নির্দেশ দিলেন কেন?
প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, পঞ্চায়েত নির্বাচনের (সরকার চায়, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হোক) আগে চাষিদের খুশি করতেই ঢালাও চাল সংগ্রহে নামছে রাজ্য। ঋণজর্জর রাজ্যে এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ কারণে নতুন করে কয়েকশো কোটি টাকা ঋণ করার দরকার কতটা, উঠেছে সেই প্রশ্নও। |
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলছেন, “বাড়তি চাল সংগ্রহের সঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই।” তাঁর বক্তব্য, সরকার ধান কেনে চাষিদের পাশে দাঁড়াতে। লাভের জন্য নয়। এ রাজ্যে যাতে এক জন চাষিকেও ধানের অভাবী বিক্রি করতে না-হয়, সেই জন্যই বেশি চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে। নাবার্ড সমবায় সংস্থাগুলিকে ঋণ দেবে। কেন্দ্র যখন টাকা মেটাবে, তা দিয়ে নাবার্ডের ঋণ শোধ করা হবে।
কিন্তু ঋণের টাকায় বাড়তি চাল সংগ্রহে নামলে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে বলে খাদ্য দফতরের অফিসারেরাই আশঙ্কা করছেন। তাঁরা জানান, ধান থেকে চাল তৈরি করে তা গুদামজাত করার জন্য বিভিন্ন চালকল ও সমবায় সংস্থার পাওনা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে সরকারের নেই। এই অবস্থায় ধান কিনতে নতুন করে ঋণ নিলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। ওই অফিসারেরা জানান, গত আর্থিক বছরে ধান কিনতে অত্যাবশ্যক পণ্য নিগমকে ২০০ কোটি টাকা ধার নিতে হয়েছিল। এ বার পাঁচটি সমবায় সংস্থাকে ঋণ নিয়ে ধান সংগ্রহে নামতে হবে।
এই ঋণের ফলে সরকারের বোঝা বাড়তেই থাকবে। ২০১১-’১২ সালে সংগৃহীত চালের মধ্যে রেশনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৪ লক্ষ মেট্রিক টন। এর বাইরে আয়লা-দুর্গত এলাকা, জঙ্গলমহল এবং সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের মধ্যে অতিরিক্ত ৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল বিলি করা হয়। তার পরেও জমে থাকা তিন লক্ষ টন চালের অর্থমূল্য অন্তত ৫৪০ কোটি টাকা। খাদ্য দফতরের এক মুখপাত্র জানান, গত বছর ধান কিনতে ২৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। চালকল-মালিকদের পাওনা ৬০০ কোটি টাকা। গুদামে পড়ে থাকা চালের দাম ৫৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের ঘাড়ে ১১৪০ কোটি টাকার বোঝা চেপেই রয়েছে। এ বার ২২.৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করতে ৩৫০০ কোটি টাকা লাগবে। তার মানে ৪৬৪০ কোটি টাকার বোঝা চাপতে চলেছে সরকারের উপরে।
অর্থনীতির বেহাল অবস্থার মধ্যে এই বাড়তি আর্থিক চাপ নেওয়া হচ্ছে কেন?
খাদ্যমন্ত্রীর জবাব, গত বছর অতিরিক্ত চাল তামিলনাডু ও কেরলে রফতানি করা হয়েছে। সেখান থেকে মোটা টাকা আসবে। সামনের বছরেও বাড়তি চাল থেকে গেলে তা বিক্রি করে বাড়ানো হবে আয়। কিন্তু চাল সংগ্রহের পরিমাণ কমানো যায় না। কেন?
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “সরকারের কিছু টাকা লোকসান হলেও যদি চাষির মুখে হাসি ফোটে, তা হলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল।” |