কেউ বলছেন, পুনর্বাসন। কারও মতে আবার, এ হল মন্ত্রীদের উপরে খবরদারি।
কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আসা তৃণমূল সাংসদদের রাজ্য সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করা নিয়ে মহাকরণের অন্দরে শুরু হয়েছে এই সব গুঞ্জন। প্রশ্ন উঠছে, মদন মিত্রের পরিবহণ বা রচপাল
সিংহের পর্যটন দফতর না হয় মেনে নেওয়া গেল। এ-ও মেনে নেওয়া গেল, স্বাস্থ্য দফতরে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের মতো সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরে উপদেষ্টা বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব কাজের ভার কিছুটা হালকা করতে চেয়েছেন। তা বলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের গ্রামোন্নয়ন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি, এমনকী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের নগরোন্নয়ন দফতরেও উপদেষ্টা বসাতে হবে?
এ সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। যেমন জানা যায়নি, নতুন পদে উপদেষ্টারা কী দায়িত্ব পালন করবেন, কাজের ক্ষেত্রে বিভাগীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কই বা কী হবে। যে সব দফতরের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে, সেই মন্ত্রীদেরও প্রায় কেউই এ সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেননি। বরং ঠারেঠোরে তাঁদের অনেকেই বুঝিয়েছেন, ব্যবস্থাটি তাঁদের পক্ষে কিছুটা ‘অস্বস্তিকর’। সরকারি নির্দেশনামায় শুধু বলা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ করবেন তাঁরা।
সরকার গড়ার পরে গত দেড় বছরে মমতা মন্ত্রিসভায় খুব বড় কোনও রদবদল করেননি। এসেছেন দুই নতুন মন্ত্রী। আর যা হয়েছে তা দফতর অদলবদল। এখন কংগ্রেস রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে তাদের শূন্যস্থানে ছ’জন মন্ত্রী নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে খুব তাড়াহুড়ো চান না।
এই অবস্থায় পদত্যাগী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করার পিছনেও তাঁর কিছু নির্দিষ্ট ভাবনা কাজ করছে বলে মহাকরণ সূত্রে খবর।
যে সাত জনকে বিভিন্ন উপদেষ্টার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন, মুকুল রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী, শিশির অধিকারী, সুলতান আহমেদ, সি এম জাটুয়া ও সৌগত রায়। দলের নির্দেশে দীনেশকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, গত রেল বাজেটে ভাড়া বাড়ানোর পরে। বাকি সকলেই এফডিআই এবং রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে সম্প্রতি কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে এসেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনই বলেছিলেন, পদত্যাগী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এমন কোনও দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে তাঁরা কাজ করার জন্য একটি করে অফিস পান। তারই ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর এই উপদেষ্টামণ্ডলী তৈরি করে মুকুলকে পরিবহণ, সুদীপকে নগরোন্নয়ন, দীনেশকে পর্যটন, শিশিরকে গ্রামোন্নয়ন, সুলতানকে সংখ্যালঘু-বিষয়ক, জাটুয়াকে সুন্দরবন উন্নয়ন এবং সৌগতকে শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তির ভার দেওয়া হল। তাঁরা কেউই অবশ্য এই পদের জন্য বেতন, গাড়ি ইত্যাদি কোনও সুযোগ-সুবিধা নেবেন না। কারণ, সাংসদ হিসেবে তাঁদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট বেতন ও ভাতা রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্বাচনগুলির পিছনেও কিছু অঙ্ক খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। যেমন, পরিবহণ দফতর। জনজীবনের সঙ্গে জড়িত এই গুরুত্বপূর্ণ দফতরটি মমতা প্রথমে দিয়েছিলেন দলের সভাপতি সুব্রত বক্সিকে। তিনি সাংসদ হয়ে যাওয়ায় তা দেওয়া হয় মদন মিত্রকে। নানা জটিলতায় এই দফতর ভুগছে। সেই কারণে এই দফতরের জন্য ইতিমধ্যেই একটি মন্ত্রিগোষ্ঠীও গড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মুকুল রায়ের মতো দলের শীর্ষনেতাকে এখানে উপদেষ্টা করে মমতা দফতরটির রাশ আরও জোরদার ভাবে ধরতে চান বলে অনেকের ধারণা। পাশাপাশি, রচপাল সিংহের পর্যটন দফতর নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী খুব সন্তুষ্ট নন। পর্যটনের উন্নয়নে পিপিপি মডেল-সহ নানা ভাবনা রয়েছে তাঁর মাথায়। সেই কাজে দীনেশ ত্রিবেদীকে তিনি ব্যবহার করতে চান। সুন্দরবন উন্নয়নে শ্যামল মণ্ডলের খামতি পুষিয়ে দেওয়ার কাজ সেখানকার সাংসদ জাটুয়াকে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজের হাতে থাকা সংখ্যলঘু বিষয়ক দফতরে সুলতানকে কাজে লাগানো কার্যত স্বাস্থ্যে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের মতো। নগরোন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন মন্ত্রী ববি হাকিমের সঙ্গে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপদেষ্টা করে মমতা আগামী দিনে শহরের রাজনীতিতে কোনও নতুন সমীকরণ চান কি না, সে-প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁরা দু’জনেই কলকাতার নেতা। কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন দফতর ছেড়ে আসা শিশির অধিকারীকে সুব্রতবাবুর দফতরের উপদেষ্টা করা এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের শিল্প দফতরে সৌগত রায়ের উপদেষ্টা হওয়াকে অবশ্য কিছুটা মন্ত্রীদের কাজে সাহায্য বলে মনে করছে মহাকরণের একাংশ।
এ দিকে, মমতার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় যথারীতি মুখ খুলেছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “এঁদেরই তো উনি (মমতা) চালাতেন এত দিন! এঁরা আবার মুখ্যমন্ত্রীকে উপদেশ
দেবেন কি?” যদিও বিরোধী দলনেতার মতে, “এই সিদ্ধান্তকে সংবিধান-বিরোধী বলতে পারব না। তবে সংবিধান-বহির্ভূত।” একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, “রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীদের উপরে হয়তো উনি (মমতা) বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। অথবা অবসর সময়ে এই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা যাতে অন্য জায়গায় যোগাযোগ না বাড়িয়ে ফেলেন, তার জন্য এই ব্যবস্থা হল।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের আবার মন্তব্য, “মন্ত্রীদের কাজের এক্তিয়ারে ওই উপদেষ্টারা যেন সক্রিয় ভূমিকা না নেন। উপদেষ্টারা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেননি।” |