পুজো পুজো গন্ধটা ছড়িয়ে পড়লেই মনটা ভারী খুশি খুশি হয়ে যায় ঝিলমিলের। একে তো সবার সঙ্গে সেজেগুজে বেরোনো, খাওয়াদাওয়ার মজা, তার উপরে কত রকম ঠাকুর, তার কত রকম থিম। ওরা এক এক দিন এক এক দিকে যায় দলবেঁধে। কোনও দিন দক্ষিণে, কোনও দিন উত্তরে, এক দিন পূর্বে, আর এক দিন আবার হাওড়ায়। এ বার যেমন ঠিক হয়েছে, সপ্তমীর দিন ওরা যাবে লেকটাউন, বাঙুর, দমদমের দিকটায়।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরার পুরস্কার জেতা প্রদীপ সঙ্ঘ ও নতুন পল্লির পুজোটা এ বার দেখবেই ঝিলমিল। এ বছর এ পুজো মাতছে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। তাই রোজকার ব্যবহারের চেনা হাঁড়ি, কড়াই-ই তাদের মণ্ডপে কখনও গড়েছে আলোকসজ্জা, কখনও বা পদ্মফুল। শিল্পী বন্দন রাহার ভাবনা, সৃষ্টির উৎস থেকেই তৈরি হয়েছে সৃজনশীলতার নানা উপকরণ। তাই মূল মণ্ডপে সমস্ত সৃষ্টির উৎস হিসেবে থাকছে সমুদ্র। পৃথিবীর আদি উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে একটি চাকা। আর সঙ্গে পূর্বসূরীদের অতন্দ্র দৃষ্টির প্রতীক হিসেবে থাকছে চোখের গঠন।
আরও একটু এগিয়ে দমদম তরুণ দলের পুজোয় আবার উল বুনে নানা মডেল, মোটিফে সাজছে চালচিত্র, তোরণ-সহ গোটা মণ্ডপ সজ্জা। প্রবেশ পথের তোরণে আকাশে মেঘ, পাখি, পুষ্পক রথের মোটিফ পেরিয়ে পরের তোরণ সাজছে মানুষের নানা কাজে, কখনও শিকার, কখনও গানবাজনার ছবিতে। তোরণ পেরিয়ে একটা আস্ত গ্রাম, তাতে মাঠ, বাড়ি, বধূ, সবের মডেল সেই উল বুনেই তৈরি। এর পরে ফের আরও এক তোরণ পেরিয়ে পায়ে পায়ে পদ্মপাতার উপর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে পদ্মফুলের কুঁড়িতে বসা মাতৃমূর্তির কাছে। সাবেক প্রতিমার গয়নাও কুরুশে উল বুনেই তৈরি, চালচিত্রে কার্পেট বুনে পটচিত্র।
এক ফাঁকে ঝিলমিলরা দেখে নেবে বাঙুর অ্যাভিনিউ প্রতিরোধ বাহিনীর পুজোটা। এ বার ওদের থিম ‘নীল দর্পণ’। মূল মণ্ডপ ঘিরে গ্রাম, নীলকুঠি, নীলচাষের মডেল, পেন্টিংয়ে ফুটে উঠবে দীনবন্ধু মিত্রের যুগান্তকারী এই নাটকের নানা দৃশ্য। থাকবে ব্রিটিশদের হাতে শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামবাংলার অশান্ত হয়ে ওঠার কাহিনি।
ফিরতি পথে কাদাপাড়া সর্বজনীনের পুজোটাও দেখে নেওয়াই যায়। ওদের থিমে এ বার আদিবাসী গ্রামের জীবনযাত্রা। মডেল গড়ে গ্রাম সাজানোর পাশাপাশি আসল গ্রামের মতোই বিকেল থেকে এ পুজোয় শোনা যাবে ধামসা মাদলের সুর, খাস আদিবাসী শিল্পীদের বাজনায়।
শেষমেশ ওরা যাবে ট্যাংরা ঘোলপাড়া সর্বজনীনে। সেখানকার থিমে এ বার কুণ্ডলিনী শক্তি। সাড়ে তিন প্যাঁচের কুণ্ডলিনী চক্রের অবয়ব একশো ফুট টিনের পাতে মোড়া। সর্পাকার শরীরে থাকবে পঁচিশটি আলোর পদ্ম। আর সর্পফণাকৃতি চূড়ার নীচে সপরিবার মা দুর্গা।
তবে এ বার ঝিলমিল মুখিয়ে আছে লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দের পুজোটা দেখার জন্য। ৫০তম বর্ষে ওদের থিমে এ বার শিকড়ে ফেরার গল্প। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে গিয়ে যে দিনযাপন, যে সব পুরনো অভ্যাস পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় জীবন, সেই অতীতকেই ফিরে দেখার ভাবনা থাকছে তাদের এ বারের থিমে। যে ফিরে দেখা ঘুরপাক খায় আগেকার একান্নবর্তী পরিবারের আনাচে-কানাচে, আগেকার সমাজের রীতিনীতিতে কিংবা পুরনো সংস্কৃতির অলিতে-গলিতে।
একান্নবর্তী পরিবার কেন, ঝিলমিলরা যে আসলে পরিবারই দেখেনি কখনও। জ্ঞান হওয়া ইস্তক অনাথাশ্রমে। আশপাশের বাড়িগুলোয় ওর বয়সী ছেলেমেয়েদের মায়ের কাছে আব্দার করা দেখে তাই বড্ড মন কেমন করে। সে জন্যই তো পুজো এলে খুশিতে ঝিলমিল করে ওঠে ঝিলমিল। হোক না মোটে পাঁচটা দিন, সে ক’দিন মা দুগ্গা ওর মা-ই তো! |