প্রশ্নগুলো উঠছে বহু দিন ধরে। খোঁচা দেওয়া হাজারো প্রশ্ন, চুলচেরা বিশ্লেষণ আর কথায় কথায় তুলনা টানা।
নিখুঁত বলতে গেলে, এ সব চলছে ঠিক এক বছর ধরে। ২০১১-র ৫ অক্টোবর দুনিয়া ছেড়ে গিয়েছিলেন অ্যাপল-স্রষ্টা স্টিভ জোবস। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আত্মপ্রকাশ করে আইফোন ৪এস। সেই জৌলুসহীন অনুষ্ঠান দেখে অনেকেই সটান বলেছিলেন জোবস সংস্থা থেকে ছুটি নিতেই অ্যাপল জাদু ফুরিয়ে আসছে। কারণ, নতুন ফোনটাতেও আহামরি কিচ্ছু নেই। অ্যাপলের সিইও হিসেবে সদ্য কার্যভার নেওয়া টিমোথি কুককে নির্মম যন্ত্রজগৎ বুঝিয়ে দিয়েছিল, এ বার থেকে তাঁর যাবতীয় বিচার হতে চলেছে কালো গোলগলা টি শার্ট আর নীল জিনসের এক অবয়বের মাপকাঠিতে। জোবসের প্রয়াণের এক দিনের মধ্যেই ধস নেমেছিল অভিভাবকহীন সংস্থার শেয়ারে। আবার প্রশ্ন কুক কি সত্যিই অ্যাপলের যোগ্য নেতা? জোবসের মতো নতুন যন্ত্র হাতে খুঁটিনাটি বোঝাতে তিনি মঞ্চে আসেন না কেন? কেন সে কাজটা সারেন তাঁর সংস্থার অন্য শীর্ষকর্তারা। সেই শুরু। এবং সেই তুলনা সমানে চলিয়াছে।
ঠিক এক বছর পরের খণ্ডচিত্রগুলো কী বলছে? বলছে, গত মাসেই মাত্র ৭.৩ মিলিমিটার পুরু আইফোন ৫ বাজারে
|
স্টিভ জোবস |
|
টিমোথি কুক |
ছেড়ে একটা
বড়সড় ছক্কা হাঁকিয়েছেন কুক। সংস্থার শেয়ারমূল্য বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। বেড়েছে আইফোনের সার্বিক বিক্রিও। এবং এত কিছু সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠছে। তা হল গত এক বছর ধরে কর্মচারী বিক্ষোভ, স্যামসাংয়ের সঙ্গে প্রযুক্তি নিয়ে মামলা, শেয়ারের দাম ওঠাপড়া ইত্যাদির জন্য অ্যাপল যত বার খবর হয়েছে, নতুন যন্ত্র বা প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য তত বার শিরোনামে এসেছে কি? তার চেয়েও বড় কথা, ৩৬ বছরের জোবস জমানায় মাত্র ১৬ বার দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছে অ্যাপলকে। আর কুকের এক বছরের রাজ্যপাটেই চার বার ক্ষমা চাওয়া হয়ে গিয়েছে!
এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি গত মাসের। আইফোন ৫-এর অপারেটিং সিস্টেম ‘আইওএস-৬’-তেই প্রথম বার গুগলের সঙ্গে জোট ভেঙে নিজস্ব ম্যাপস অ্যাপ্লিকেশন এনেছিল অ্যাপল। কিন্তু তাতে এত গোলমাল যে কুককেই ক্ষমা চেয়ে গ্রাহকদের বলতে হয়, আপাতত যেন তাঁরা গুগল ম্যাপসই ব্যবহার করেন। ফলে বিস্মিত বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, প্রযুক্তির প্রতিটা ধাপ খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে যে সংস্থা তাদের তৈরি নতুন জিনিস বাজারেই আনত না, তাদের এমন অধঃপতন কেন?
অস্বস্তি আরও আছে। ফেব্রুয়ারিতে চিনে আইফোন আর আইপ্যাডের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় শুরু হয় বিক্ষোভ। কাজ বন্ধ করা সেখানকার কর্মচারীদের দাবি সঙ্গত বলেই মানতে হয়েছিল কুককে। যে আইফোন ৫-কে অস্ত্র করে নিন্দুকদের কিছুটা জবাব দিয়েছেন কুক, তারও ছবি-নকশা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের আগে। ফলে, ক্রেতারা আসল আইফোন ৫ কিনছেন কি না, এমন একটা উড়ো সন্দেহও বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সেই সূত্রেই জোবস কিংবদন্তির সঙ্গে আর এক দফা তুলনা। জোবস নতুন যন্ত্র হাতে মঞ্চে না আসা পর্যন্ত তো সেটা সম্পর্কে প্রায় কিচ্ছুটি জানা যেত না। প্রশ্ন উঠল, সেই ট্রেডমার্ক গোপনীয়তা থেকে কি সরে আসছে কুকের অ্যাপল?
ঠিক এইখানেই অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আর এক দল বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বলছেন, এ অ্যাপল নতুন অ্যাপল। গোপনীয়তা আর রহস্যের মোড়কটা সরিয়ে দিয়ে আসলে গ্রাহকদের সাদরে কাছে টেনে নিতে চাইছে তারা। গত ফেব্রুয়ারিতেই একটি হাসপাতালে ৫ কোটি ডলার দান করেছে অ্যাপল সংস্থার ইতিহাসে এই প্রথম। তার পর মার্চে অ্যাপলের শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৫-এর পরে সেটাও এই প্রথম বার।
এর সঙ্গে রয়েছে চিনের কারখানায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের দাবি সঙ্গত বলে মেনে নেওয়া। এবং সর্বোপরি, ‘ভুল হয়েছে’ কথাটা নির্দ্বিধায় বলতে পারা। তাতে তো দোষের কিছু নেই। যন্ত্রসম্রাটের ভাবমূর্তি ছেড়ে তাই এ যেন এক নরম অ্যাপল।
কুকের ভবিষ্যৎ সময়ই বলবে। আসলে একটা খাঁটি কথা তিনি জানেন। তিনি জাদুকর জোবস নন। নাটকীয় উপস্থিতির জোর তাঁর নেই। কিন্তু ব্যবসাটা করতে জানেন। তাই মঞ্চে খুব একটা আসেন না। কারণ মঞ্চের বাইরেও একটা খেলা আছে! |