ঘাতকের মুকুটে আর একটি পালক।
অনেকটা যেন তিন মার পালোয়ান! এত দিন পর্যন্ত ক্যানসারের বড় কারণ হিসেবে ধূমপানকে দায়ী করা হত। হার্ট অ্যাটাকের জন্যও চিকিৎসকদের তিরস্কারের তালিকায় ছিল ওই নামটাই। এ বার জানা গেল, স্ট্রোকের নেপথ্যেও ধূমপানের বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর সমীক্ষায় ধরা পড়েছে এই তথ্য। জানা গিয়েছে, ভারতে যত মানুষ স্ট্রোকের শিকার, তার মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী ধূমপান। এই তথ্যকে সমর্থন করেছে আমেরিকার ন্যাশনাল স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ‘স্ট্রোক অ্যান্ড সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিজেজ’। তারাও জানাচ্ছে, বিশ্বে স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে ধূমপান। ভারতের মতো দেশে এই হার ক্রমশ বাড়ছে।
আইসিএমআর চার বছর ধরে এক লক্ষ মানুষের উপরে সমীক্ষা করে যে রিপোর্টটি তৈরি করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, রোগের চেনা ধাঁচ বদলে গিয়েছে। সমীক্ষক দলের অন্যতম সদস্য, স্নায়ু চিকিৎসক শ্যামল দাস বলেন, “এত দিন মনে করা হত, ডায়াবিটিস এবং হাইপার টেনশনই স্ট্রোকের জন্য দায়ী। সমীক্ষায় কিন্তু দেখলাম, ধূমপান ক্ষতি করছে খুব বেশি মাত্রায়। শুধু বিড়ি-সিগারেট নয়, গুটখাও সমান ক্ষতিকর। অথচ বেশির ভাগ মানুষই এটা জানেন না।”
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বছর কয়েক আগেও ৫৫ থেকে ৭০ বছরের বয়সীদের স্ট্রোক বেশি হত। ইদানীং শুরুটা চল্লিশের আশপাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য ধূমপানই মূল কারণ বলে চিকিৎসকদের মত। এর জেরে মহিলাদের মধ্যেও স্ট্রোকের প্রবণতা বাড়ছে। একই সঙ্গে ধূমপান এবং বছরের পর বছর গর্ভনিরোধক ওষুধ খেলে স্ট্রোক বেশি হয় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র গবেষণায় জানা গিয়েছে।
স্ট্রোক হয় কী ভাবে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দু’ভাবে। মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে কিংবা মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে। তাই রক্তচাপ বজায় রাখাটা সব চেয়ে জরুরি। |
শ্যামলবাবু জানান, তাঁরা যে এক লক্ষ মানুষকে নিয়ে সমীক্ষা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৮৫৩ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। সমীক্ষা চলাকালীন তাঁদের মধ্যে ৪৫২ জনের মৃত্যু হয়। এবং এর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় নম্বরেই রয়েছে ধূমপান। স্ট্রোক প্রতিরোধের উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে সমীক্ষায়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, একটা মানুষের জীবন লন্ডভন্ড করে দিতে পারে স্ট্রোক। বহু ক্ষেত্রেই এর থেকে মৃত্যু হয়। যাঁরা বেঁচেও যান, তাঁদের একটা বড় অংশ পক্ষাঘাত, স্মৃতিভ্রংশ এবং গভীর অবসাদের শিকার হন। পক্ষাঘাত এমন চেহারা নেয় যে, বাকি জীবনটা বিছানায় কেটে যায়। অনেকেরই স্মৃতিভ্রংশ কাটে না। এমনকী অবসাদের জেরে আত্মহত্যাও করেন বহু মানুষ।
চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, সিগারেট বা গুটখার ক্ষেত্রে ক্যানসার হতে পারে বলে যেমন সতর্কীকরণ থাকে, তেমন স্ট্রোকের কথাও লেখার সময় এসেছে।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক জানালেন এমন বেশ কয়েক জন রোগীর কথা, যাঁদের ধূমপান ছাড়ার কথা বললে, তাঁরা মাঝেমধ্যে হার্ট এবং ফুসফুসের পরীক্ষা করতেন। তাঁদের ওই দুই অঙ্গে সমস্যা ছিল না। তাই বেপরোয়া ধূমপান চালিয়ে গিয়েছিলেন বহু বছর। এঁরাই পরবর্তী সময়ে স্ট্রোকের শিকার হন এবং প্রত্যেকেই ষাট পেরনোর আগেই মারা যান।
‘স্ট্রোক ফাউন্ডেশন অফ বেঙ্গল’ কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, স্ট্রোকের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ৬৬ শতাংশ, ধূমপান ৩৩ শতাংশ, ডিসলিপিডেমিয়া ৩১ শতাংশ, ডায়াবিটিস ২৮ শতাংশ এবং ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ ২২ শতাংশ দায়ী।
স্নায়ু চিকিৎসক দেবাশিস চক্রবর্তী বললেন, “যত জন স্ট্রোকের রোগী পাই, তার মধ্যে ৬০ শতাংশই ধূমপানের কারণে এই রোগের শিকার। আমরা তাই রোগীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করি, যাতে তাঁরা অভ্যাসটা ছেড়ে দেন। মানুষের শরীরকে সব দিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে রোগে বেঁধে ফেলে এই বদ-অভ্যাস।”
গবেষকরা জানাচ্ছেন, ধূমপান রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলকে প্রশ্রয় দেয়। উল্টে তাড়ায় ভাল কোলেস্টরলকে। তা হলে ধূমপান ছেড়ে দিলেই কি স্ট্রোকের আশঙ্কা কমে যায়? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অবশ্যই যায়। কিন্তু তা ধীরে ধীরে কমে। প্রথম বছরে ঝুঁকি যতটা কমে, পাঁচ বছর পরে সেই ভয় অনেকটাই কম থাকে। তাই বেশি ভাবনা চিন্তার অবকাশ না রেখে সিদ্ধান্তটা দ্রুত নেওয়ার পক্ষেই রায় দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। |