বার বার আমাশা হত বেকবাগানের বছর বত্রিশের মহম্মদ জাভেদের। এলেবেলে অসুখ মনে করে ডাক্তার দেখাননি। বাজারচলতি আমাশার ওষুধ ইচ্ছেমতো দোকান থেকে কিনে খেয়েছেন। হঠাৎ রক্তবমি শুরু হয়। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন সাধারণ জীবাণুরাই জাভেদের শরীরে অন্ত্র থেকে শ্বাসনালী পর্যন্ত ফুটো করে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলেছে!
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের কথায়, “অনিয়মিত ভাবে আমাশার ওষুধ খাওয়ায় জাভেদের দেহে ওই ওষুধে প্রতিরোধ জন্মায়। আমাশার জীবাণুরাই শরীর জুড়ে লম্বা গর্ত করে ফেলেছিল। যকৃত আর ফুসফুসের নীচে জমে থাকা পুঁজ-ই ওঁর মুখ দিয়ে বার হত।” চার মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হন জাভেদ। এই কেসটি গত মাসেই ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়েছে। চিকিৎসকেরা আলাদা করে লিখেছেন, সাধারণ অসুখেও রোগীর নিজে নিজে ডাক্তারির ফল মারাত্মক হতে পারে।
কিন্তু কে শুনছে সে কথা? সরকারি রিপোর্টই বলছে, ভারতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা ওষুধের (ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ) ব্যবসার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২৩ শতাংশ! এ বিষয়ে বিশ্বের প্রথম ১২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান। ড্রাগ কন্ট্রোলার অফ ইন্ডিয়া জি এন সিংহের বক্তব্য, “নতুন করে ৯১টা ওষুধকে আমরা চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, যক্ষ্মার ওষুধ ও নেশা হয় এমন কিছু ওষুধ রয়েছে। এগুলো আর প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হবে না।” কিন্তু ড্রাগ-ইন্সপেক্টরের সংখ্যা না-বাড়ালে দোকানে নজরদারি করবে কে? দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওই ওষুধগুলি যে সত্যিই বিক্রি হচ্ছে না, সেটা কে নিশ্চিত করবে? অনলাইনেও এখন ওষুধ কেনাবেচা হয়, সেটাই বা আটকাবেন কারা? রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে ১৪০ জন ইন্সপেক্টর থাকার কথা। সেখানে ৫৯টি পদ খালি। কর্তৃপক্ষই বলছেন, “এই কর্মী নিয়ে নজরদারি চালানো সম্ভব নয়।”
অতএব, জ্বর, সর্দি, ব্যথা, ব্রণ, মাথা ঘোরা থেকে শুরু করে লিঙ্গ বড় করা বা গর্ভপাতের ওষুধ সব কিছুই ইচ্ছামতো কিনে খাওয়া হচ্ছে। মুড়ি মুড়কির মতো প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে, মানুষের মধ্যে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকে প্রতিরোধ ক্ষমতা হুহু করে বাড়ছে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগির বলছিলেন, ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ, গর্ভপাত বা পিরিয়ড এগোনো-পিছোনোর ওষুধ আকছার কিনে খাওয়া হচ্ছে। এতে পিরিয়ড অনিয়মিত হচ্ছে। ভুল ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ খেয়ে অনেকে সন্তানধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছেন। তাঁর কথায়, “গর্ভপাতের ওষুধ নিজে-নিজে খাওয়ায় ভ্রূণের কিছুটা হয়তো জরায়ুতে রয়ে গেল। সেখান থেকে সংক্রমণ হচ্ছে, ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে যাচ্ছে!”
‘রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজির চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্ত অন্য একটি প্রবণতার কথাও শোনালেন। পুরনো প্রেসক্রিপশন দোকানে দেখিয়ে অনেকেই ওষুধ নিচ্ছেন। এক প্রৌঢ়ের চোখের সমস্যার জন্য স্টেরয়েড দিয়েছিলেন হিমাদ্রিবাবু। পরে তাঁর আবার একই ধরনের সমস্যা হয়। ডাক্তার না দেখিয়ে পুরনো ওষুধই ফের কিনে এক বছর লাগান তিনি। অন্ধ হতে বসেছেন ওই ভদ্রলোক।
নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের ত্বক বিশেষজ্ঞ সুদীপ দাস আবার জানালেন, ব্রণ-মেচেতা, দাদ-হাজা, চুল পড়া বা শ্বেতী দূর করার ওষুধ শুধু বিজ্ঞাপনের চমকেই কিনে ফেলছেন মানুষ। তার পর সংক্রমণ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসছেন। চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় উদ্বিগ্ন বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যালপ্রাজোলাম জাতীয় ওষুধ বিক্রি নিয়ে। এগুলি ঘুমের ওষুধের কাজ করে। তাঁর কথায়, “এই ভাবে আত্মহত্যা প্রবণ রোগীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে!”
উল্টোপাল্টা ব্যথার ওষুধ খেয়ে কালো পায়খানা, বমি, পেট ব্যথার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেকে। এসএসকেএম হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের জয়ন্ত দাশগুপ্তের অভিযোগ, একটু ডায়েরিয়ার মতো হলেই লোকে দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বা মেট্রোনিডাজল জাতীয় ওষুধ কিনে খান। কোর্সও শেষ করেন না। ফলে শরীরে ওষুধের প্রতি প্রতিরোধ জন্মাচ্ছে, যা মারাত্মক। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট গোপালকৃষ্ণ ঢালির কথাতেও, “ভুল অ্যান্টিবায়োটিক বা সালফার ড্রাগ নিজে-নিজে খেয়ে জন্ডিস হয়ে গিয়েছে এমন অনেক রোগী আমরা পাই।” এই সমস্যার সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য দফতরের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সুব্রত মৈত্র। তাঁর যুক্তি, চিকিৎসক কম। গ্রামাঞ্চলের সব জায়গায় চিকিৎসার সুবিধা এখনও পৌঁছনো যায়নি। বেশির ভাগ চিকিৎসকের ফি এখন কম করে ২০০ টাকা। সামান্য অসুখে ২০০ টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা কত জনেরই বা থাকে? তাই তাঁরা দোকানে গিয়ে ওষুধ কেনেন। তাঁর কথায়, “ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ’ বন্ধ করতে হলে গোটা ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, আপাতত যা অসম্ভব।” |