অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করার পর ভুটান বলল, প্রজাপতিটাকে তাড়িয়ে দাও না বাবা! টিকটিকিতে খেয়ে নেবে যে ওটাকে।
সন্দীপ পত্রিকা পড়ছিল। ছেলের কথায় মুখ তুলল। ভুটান দেখিয়ে দিল। টিউবলাইটটার একটু নীচে দেওয়ালের গায়ে প্রজাপতিটা বসে আছে। পাখনা দুটো সোজা হয়ে একসঙ্গে জোড়া।
শীতকাল। জানলা সব বন্ধ। কখন ঢুকে পড়েছে, আর বেরোতে পারেনি।
না, কোনও টিকটিকি চোখে পড়ল না। ঠান্ডা যা পড়েছে! এই সময়ে ওরাও একটু কম বেরোয়। কিন্তু চোখের সামনে অমন খাবার! লক্ষ্য কি আর রাখেনি?
ঠিক তাই। আলোর ফিটিংসের ফাঁকে একটা লেজের নড়াচড়া নজরে পড়ল। তার মানে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। সাত বছরের ছেলের দিকে এক বার তাকাল সন্দীপ। ভুটানও দেখছিল। চোখাচুখি হতেই সে দিকে ইশারা করল। প্রজাপতিটাকে বাঁচানোর জন্যে বাবার ওপর ভরসা করে রয়েছে। সন্দীপ সোফা ছেড়ে উঠল। কিন্তু কী করে ওটাকে সরানো যায়!
প্লেট মোছার তোয়ালেটা দুলিয়ে দুলিয়ে দেওয়াল থেকে উড়িয়ে দিল পতঙ্গটাকে। বেচারি সুন্দর দুটো বাহারি পাখনা মেলে এ দিক ও দিক উড়ে বেড়াচ্ছে। টিউবের আলোয় ডানা দু’টি ঝলমলিয়ে উঠছে থেকে থেকে। এমন সুন্দর রং সব প্রজাপতির হয় না। পাখনা দুটোয় কী চমৎকার নকশা! ঘুরেফিরে প্রজাপতিটা সেই আলোর কাছে এসেই বসে পড়ল।
সন্দীপ আবার এক বার তাড়াল। ফল একই। পরের বার এসে বসল সিলিং-এ। আলো থেকে বেশ দূরে। টিকটিকির দেখা নেই।
রাতে খেতে বসে ঝটপটানির শব্দ। প্রজাপতিটা টিকটিকির মুখে। ফরফর করে ডানা দুটো নাড়াচ্ছে। |
টিকটিকিটা গলা উঁচিয়ে দেওয়ালে ঝটকা মারছে বার বার। টিউবের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল পাখনা থেকে রঙিন গুঁড়ো ঝরে পড়ছে ধুলোর মতো। একটু পরে ডানা দুটো খসে পড়ল মেঝেতে।
ভাগ্যিস ভুটান আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। ছেলেকে মিছে ভরসা দেওয়ায় সন্দীপের লজ্জা করছিল, সঙ্গে দুঃখও। সুন্দর প্রজাপতিটাকে সে বাঁচাতে পারল না। পাখা দুটো সন্দীপ একটা খামে ভরে রাখল।
পরের দিন আবার একটা প্রজাপতি ঠিক কালকের জায়গায় এসে বসে আছে। হুবহু একই দেখতে। কালকেরটাই হয়তো। সারা দিন বেরোতে পারেনি ঘর থেকে।
আজ বাবার দেরি হবে ফিরতে। ভুটান নিজেই ওটাকে ওড়াবার চেষ্টা করল কয়েক বার। কিছুতেই উড়ল না। একই জায়গায় বসে রইল। আলোর তলা থেকে টিকটিকিটা বেরিয়ে পড়েছে। অনেক বার লেজ খসে খসে গোড়াটা মোটা। থাক কাটা কাটা।
ভুটান বিপদ বুঝে আবার প্রজাপতিটাকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। বেকার। টিকটিকিটা কোনও আওয়াজ না করে এগিয়ে আসছে। এত আস্তে আস্তে এগোচ্ছে, টের পাওয়ার জো নেই। প্রজাপতি জানতেই পারছে না ওকে খেতে আসছে। আর একটু! ভুটান হাতের তোয়ালেটা দেওয়ালে ছুড়ল। পৌঁছল না। টিকটিকিটা ভয় পেয়ে থমকে থাকল। লেজটা একটু একটু দোলাচ্ছে এ পাশ ও পাশ। আবার এক বার ছোড়ার আগে টিকটিকি ঝাঁপিয়েছে।
ভুটান ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কোন শব্দ নেই। চোখ দুটো সামান্য ফাঁক করে দেখল প্রজাপতিটার কিছুই হয়নি। যেমন বসেছিল তেমনি আছে। ডানা দুটো ওপরে জোড়া। একটু কাঁপেওনি।
টিকটিকিটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ ঘুরিয়েছে। ফিরে কিন্তু গেল না। প্রজাপতিটাকে ধরার জন্যে স্প্রিং-এর মতো ছিটকে এল। এ বারও বিফল। প্রজাপতি অনড় একই জায়গায়। একটু পিছিয়ে এসে টিকটিকি ওটাকে রাগীরাগী চোখে দেখছে। মুখটা হাঁ করে ঝাঁপাল।
ভুটান অবাক হয়ে দেখল, টিকটিকির মুখে না বন্দি হয়ে প্রজাপতি বসে আছে তার পিঠের ওপর। শুঁড় দিয়ে কামড়ে ধরেছে ঘাড়ের কাছটা।
ভুটান অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছে ও দুটোর দিকে। মাকে ডাকার কথাও মনে নেই। মা পাশেই রান্নাঘরে আছে। ভুটান একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর বুকটা ঢিবঢিব করছে। কয়েক সেকেন্ড। টিকটিকিটা কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে পড়ে গেল। থুপ করে শব্দ হল একটা। পড়ে গিয়ে ওটা পড়েই থাকল। আর উঠল না। পা চারটে অদ্ভুত ভাবে শূন্যে তুলে একদম নিথর।
ওপরে তাকিয়ে প্রজাপতিটাকে আর দেখতে পেল না ভুটান। কখন কোথা দিয়ে চলে গেল কে জানে!
ভুটানের কেমন ভয় ভয় করছে। চোখের সামনে যেটা হল সেটা কি কখনও হতে পারে? ভাবতে ভাবতে ও রান্নাঘরে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
মা বলল, আর একটু বাকি। তুমি নিজে নিজে কিছুটা পড়ে নাও। আমি একটু পরেই আসছি।
ভুটান দাঁড়িয়েই রইল।
মা জিগ্যেস করল, খিদে পেয়েছে? খেতে দিয়ে দেব?
ভুটান বলল, না, বাবা এলে খাব।
ঠিক আছে। তুমি ততক্ষণ একটু টিভি দেখে নাও। ভুটান তবু গেল না।
রাতে একসঙ্গে খেতে বসে ভুটান বাবাকে আর মাকে ঘটনাটা বলল। শুনে দু’জনেই অবাক। এমনটাও হয় নাকি! প্রমাণ তো পড়েই রয়েছে ঘরের কোণে। মরা চিৎপটাং টিকটিকিটা।
বাবা হাত ধুয়ে একটা খাম নিয়ে এল। তার ভেতরে প্রজাপতির দুটো পাখনা। তখনও যেন জীবন্ত। ঝলমলে আলো ঠিকরোচ্ছে সে দুটো থেকে।
মা গালে হাত দিয়ে বলল,
বলছ কী, প্রজাপতিটা তা হলে ভূত হয়ে প্রতিশোধ নিল! |