|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: ডাডাইজ্ম |
গৌতম চক্রবর্তী |
মোনালিসার রহস্যময় হাসি, নান্দনিক ঐতিহ্য এবং শৈল্পিক সৌন্দর্য তখন চটকে চোদ্দো। ১৯১৯। মাত্র এক বছর আগে শেষ হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধ। লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা বিখ্যাত সুন্দরীর ছবিটি ফের এঁকেছেন ফরাসি শিল্পী মার্সেল দুশ্যা। এবং এঁকেই ক্ষান্ত হননি। মোনালিসার একটি গোঁফ এঁকে দিয়েছেন। চিবুকে ছাগলদাড়ি। ছবির নীচে লেখা L.H.O.O.Q.। ফরাসি উচ্চারণে যে সংক্ষেপ-বাক্যের মানে, ‘মহিলার নিতম্বটি ফাটাফাটি।’ শিল্পসুষমা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য... এত দিনের চেনা ধারণা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন মার্সেল।
তাঁর অবশ্য এটিই প্রথম ‘সাংস্কৃতিক গুন্ডামি’ নয়। মহাযুদ্ধ চলার সময়েই, ১৯১৭ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক শহরের এক প্রদর্শনীতে ‘ফাউন্টেন’ নামে ভাস্কর্য জমা দিয়েছিলেন। ‘জে এল মট আয়রন ওয়ার্কস’ নামে এক কারখানা থেকে একটি ‘ইউরিনাল’ কিনে সেটিকে জাস্ট উল্টো করে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। উচ্চবর্গের সংস্কৃতিবোধ বা ‘হাই কালচার’-এ বিশ্বাস করেন না দুশ্যাঁ এবং তাঁর বন্ধুরা। তাঁরা জানেন, প্রস্রাবখানা থেকে খিস্তি, সবই শিল্প তথা জীবনের অঙ্গীভূত। এখানেই দাদাগিরি। শিল্পকলার সমঝদারদের ভাষায়, ‘ডাডাইজ্ম’।
এই ডাডাইজ্ম প্রথম মহাযুদ্ধের অবদান। যুদ্ধ যখন মাঝপথে, ১৯১৬-য় বেরোয় প্রথম ম্যানিফেস্টো। যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে, ১৯১৮-য় দ্বিতীয়টি। দুটোই বেরিয়েছিল সুইটজারল্যান্ডের এক নাইটক্লাব থেকে। রণমদে মত্ত ইউরোপে সুইটজারল্যান্ড তখন ব্যতিক্রম, যুদ্ধে নাম লেখায়নি সে। ফলে হিউগো বল, ত্রিস্তান জারা, মার্সেল জেঙ্কো প্রমুখ চিত্রশিল্পীরা তখন জার্মানি, রোমানিয়া ছেড়ে সেই নিরপেক্ষ দেশের মাটিতে। |
|
প্রথম মহাযুদ্ধ। হত এক কোটি মানুষ। আহত ও বিকলাঙ্গ দুই কোটি। কোথায় গেল ইউরোপীয় সভ্যতার আলোকপ্রাপ্তি ও মুক্ত চিন্তা? আসল কথা তা হলে যুক্তিবাদ নয়? বরং গায়ের জোরে অন্য দেশের জমি দখল করে উপনিবেশ তৈরি! তবে কী এসে যায় ‘যুক্তিবোধ’ নামের ছেঁদো গুলতানিতে! চিন্তাভাবনার দেওয়ালগুলি তখন একের পর এক ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ। ডাডাদের ম্যানিফেস্টো তাই যুক্তি ও কার্যকরণসম্মত শিল্পের বিরুদ্ধে জেহাদ। ‘যুক্তিবোধ বা লজিক সব সময় ভুল। শুঁয়োপোকার মতো সে, স্বাধীনতার দম আটকে মারতে চায়। যুক্তিবোধের সঙ্গে শিল্পের বিয়ে মানে অজাচার।... কিছু লোক ভাবে, তারা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণ ভয়ঙ্কর অসুখ, বুর্জোয়া ব্যবস্থাকেই প্রতিপন্ন করে সে’, লেখা হল দ্বিতীয় ডাডা ম্যানিফেস্টোয়।
১৯১৮ সালে ত্রিস্তান জারা-র লেখা দ্বিতীয় ডাডা ম্যানিফেস্টোটি বেশ বড়। পাঁচ ভাগে বিভক্ত, ১৪টি অনুচ্ছেদ। ১৯১৬ সালে হিউগো বল-এর লেখা প্রথম ম্যানিফেস্টো অবশ্য ছোট, মাত্র ছ’টি অনুচ্ছেদ। কারণ, সেটি নাইট ক্লাবে পড়ে শোনানোর জন্য লেখা। জুরিখের সেই নাইট ক্লাবে শিল্পীরা কেউ ড্রাম বাজাচ্ছেন, কেউ বা পিয়ানো। কেউ আবার বেলি ডান্সারের মতো পেট নাচাচ্ছেন। যুক্তিবোধের দর্শন আর ক্যাবারেতে তফাত নেই। নাইট ক্লাবের নাম তাই ‘ক্যাবারে ভলতেয়ার’!
ক্যাবারে ভলতেয়ার থেকেই ডাডা চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ, আমেরিকা, সর্বত্র। মহাযুদ্ধের পর জার্মানির কোলোন শহরের এক পাব-এ ডাডা শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী। প্রস্রাবখানার পাশ দিয়ে ঘুরে আসতে হবে, এক মহিলা দর্শকদের সামনে সর্ব ক্ষণ অশ্লীল কবিতা পড়ে যাবেন। গিটার আর পিয়ানোর তালে পড়া হচ্ছে কবিতা, ‘গডজি বেরি বিম্বা/ গ্ল্যানড্রিডি লাউলি লোনি।’ প্রতিটি শব্দই অর্থহীন। কিন্তু সুর ও শব্দের ঝঙ্কারে শুরু হল ‘সাউন্ড পোয়েট্রি’। ঘড়ি, সাইকেলের পুলি, লিভার, পিস্টন ইত্যাদি যান্ত্রিক জিনিস দিয়ে তৈরি হল ভাস্কর্য। ডাডা শিল্পী, কবির জমায়েত মানে তখন জ্যাজ আর আফ্রিকান সঙ্গীত। আজকের সাররিয়ালিজ্ম, অ্যান্টি-কবিতা, পপ আর্ট ইত্যাদি অনেক বিস্ফোরক কিছুর বীজ ছিল সেই ডাডা
সূর্যের আলোয়।
প্রথম ম্যানিফেস্টোর প্রথম লাইন: ‘শিল্পের নতুন প্রবণতার নাম ডাডা। এখনও কেউ জানে না, কিন্তু আগামী কাল জুরিখের সবাই এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে।’ দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টোর প্রথম লাইন, ‘ডাডা শব্দের জাদু সাংবাদিকদের অদেখা এক জগতের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে ওই শব্দের কোনও গুরুত্ব নেই।’ জীবনমুখী গানের মতো প্রথম দুই বছরে সাংবাদিক ও সমালোচকদের থেকে বহু নিন্দামন্দ শুনেছিল ডাডাবাদ। সাংবাদিকদের উদ্দেশে আঁতেল খিস্তি শুরু দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টোতেই, ‘হে মানবতা, দয়ালু বুর্জোয়া, সাংবাদিক কুমারীরা (জার্নালিস্ট ভার্জিন্স), তোমরা এগিয়ে যাও। আমি সিস্টেমের বিরুদ্ধে। সিস্টেম বলে কিছু না থাকাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সিস্টেম।’
ডাডারা সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে কেন? ‘শিল্প ব্যক্তিগত বিষয়। শিল্পী নিজের আনন্দের জন্য তাকে সৃষ্টি করেন। আর যে শিল্প সবাই বুঝতে পারে, তা সাংবাদিকের সৃষ্টি।’ শব্দ ও ভাষার ছকবাঁধা সাংবাদিকী প্রকরণ থেকে দুনিয়াকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল ডাডাবাদ। ছকবাঁধা গৎ থেকে ভাষাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল ডাডা। ম্যানিফেস্টোয় লেখা, ‘ডাডা গ্যেটে, ডাডা দলাই লামা, ডাডা জার্মানি, ডাডা ডেরা ডাডা।’
ডাডা শব্দের মানেও বলেছে ম্যানিফেস্টো। ‘কোনও কোনও নিগ্রো জনজাতি গরুকে ডাডা বলে। রুশ ও রোমানীয় ভাষায় ডাডা মানে কাঠের ঘোড়া।’ দেশ ছেড়ে জুরিখে বাসা-বাঁধা ওই অভিবাসীরা কি ভাষার শিকড় থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন?
নীতিবোধ, আবেগপ্রবণতা সব কিছু থেকে মুক্তি খুঁজেছে ডাডাবাদ। ‘নীতি মানে দান, সহানুভূতি। হাতির মতো, গ্রহের মতো বেড়ে যাওয়া ওই দুটো চর্বির দলাকে ভাল বলা হয়। কিন্তু ভাল মানে স্বচ্ছ পরিষ্কার এক বোধ, যা রাজনীতি ও আপস-মানসিকতার বিরুদ্ধে।’ স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ ধ্বংসের ডাক দেয় ডাডা।
১৯১৬ সালের জুরিখে ওই ধবংসের ডাকের মধ্য থেকেই ডাডারা খুঁজছিলেন শিল্পের মুক্তি। জুরিখেই তখন রয়েছেন এক আইরিশ অভিবাসী। চোখে কম দেখেন, তবু বাঁধা গৎ থেকে ভাষা ও সাহিত্যকে বের করে আনছেন। লিখছেন ‘ইউলিসিস’ নামের উপন্যাস। জেমস জয়েসের চেতনাপ্রবাহ আর ডাডা ম্যানিফেস্টো, দুটোই পাশাপাশি চলছিল সেই শহরে।
ছিল বিপ্লবী স্পর্ধাও! ডাডাদের প্রথম ম্যানিফেস্টোয় পাশাপাশি দুটি বাক্য। ‘শেষ না হওয়া ডাডা মহাযুদ্ধ, শুরু না-হওয়া ডাডা বিপ্লব।’ ঘটনা, ক্যাবারে ভলতেয়ার-এর সময়েই জুরিখ শহরে ছিলেন এক রুশ নেতা। জুরিখে বসেই ‘পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পরিণতি সাম্রাজ্যবাদ’ লিখেছিলেন লেনিন। ভবিষ্যৎ গুনতে জানলে ম্যানিফেস্টো লেখকরা হয়তো ডাডা গ্যেটে, ডাডা বুদ্ধের পাশে ডাডা লেনিনও লিখতেন!
পুনশ্চ: ভেতো বাঙালির ধাতে ডাডাগিরি সয় না। ‘চরমের নতুন নমুনা যুরোপীয় সাহিত্যের ডাডায়িজ্ম। বিকারের দশায় প্রলাপের শক্তি বেড়ে ওঠে’ ‘সাহিত্যের পথে’ বইয়ে লিখছিলেন এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী লেখক। নাঃ, তাঁকে ডাডা রবীন্দ্রনাথ বলা গেল না! |
|
|
|
|
|