প্রবন্ধ...
পরিবর্তনের শেক্সপিয়র

দৃশ্য ১: অত্যাচারের জমানা শেষ, ম্যাকবেথ যুদ্ধে হত। সিংহাসনে বসবেন ম্যালকম। প্রজাদের উদ্দেশে তিনি বক্তৃতা দেন, ‘প্রয়োজনে দশ বছরের কর্ম সম্পূর্ণ করতে হবে দশ দিনে।’ কথাটা শেক্সপিয়রের নাটকে ছিল না। কৌশিক সেনের মঞ্চায়নে এই সংলাপ উঠে আসছে, হলভর্তি লোক হেসে গড়িয়ে পড়ছে।

দৃশ্য ২: চন্দন সেনের নাটকে ব্রুটাস জুলিয়াস সিজারকে শেষ করতে চায়, জানায়, ‘ক্ষমতাপ্রিয় লোকেরা প্রথমে বিনয়ী ভাব দেখায়। যেই ক্ষমতায় পৌঁছায়, অমনি বিনয়কে দুর্বলতা ভাবে।’ শেক্সপিয়রের মাধ্যমে ধরা দিচ্ছে আজকের রাজনীতি।

দৃশ্য ৩: বিভাস চক্রবর্তীর ‘হ্যামলেট’। পানশালায় শেক্সপিয়রের নাটকটি অভিনীত হচ্ছে। শেষ দৃশ্যে গুলির আওয়াজ। পিছনে ভয়েস-ওভার: ‘এনকাউন্টার চলছে। মানুষ মরছে। কার গুলি, কার ট্রিগার আজ আর বোঝা যায় না।’ নাটক শেষে ডেনমার্কের যুবরাজের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে আজকের সময়।

সাড়ে চারশো বছর আগের শেক্সপিয়র এই ভাবেই, বাংলা নাটকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন আজকের রাজনীতি। আর তাই নিয়েই শোরগোল। কেন নষ্ট করা হচ্ছে শেক্সপিয়রের শুদ্ধতা? কেন তাঁকে বেঁকিয়ে আনতে হচ্ছে আজকের রাজনীতিতে? এই ‘বিশুদ্ধ শেক্সপিয়র’বাদীদের উৎপল দত্তের ভাষায় মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ‘শেক্সপিয়রের যুগে থিয়েটারটি কী মাল ছিল জানেন তো? আলোর ব্যবহার নেই, দুপুর ২টা থেকে ৫টা অবধি অভিনয় হত। বৃষ্টি নামলে অভিনয় স্থগিত। ছেলেরা মেয়ের পার্ট করছে। অভিনেতারা চেঁচাচ্ছেন।’
শেক্সপিয়রের মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য আজকের নয়। পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে। ‘টেম্পেস্ট’ নাটকে নির্বাসিত ডিউক প্রস্পেরো তাঁর কন্যাকে নিয়ে জনমানবহীন এক দ্বীপে পৌঁছন। ওই দ্বীপেই থাকে ক্যালিবান। তার মাকে আলজিরিয়া থেকে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রস্পেরো দ্বীপে এলে ক্যালিবান তাঁকে ফল, ঝর্নার জল দেয়। কিন্তু প্রস্পেরো তাঁর জাদুবিদ্যার বলে দ্বীপের অধিপতি হয়ে বসেন। শুদ্ধ শেক্সপিয়রবাদী বলবেন, ক্যালিবান দ্বীপের ‘নেটিভ’ বাসিন্দা নয়। আলজিরিয়ার সন্তান। কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনীতি তাঁদের হাওয়া কেড়ে নিয়েছে। লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা মহাদেশের লেখকরা বারংবার বলেন, ক্যালিবানই তাঁদের প্রতীক। একদা ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স থেকে জাহাজ চেপে প্রস্পেরোর দল এসে তাঁদের জমিজমা, ভাষা কেড়ে নিয়েছিল। নাইজিরিয়া বা কিউবা শেক্সপিয়রকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই, বাংলা নাটকেই গেল গেল রব তুলতে হবে?
রাজনীতিই কলকাতার মঞ্চে শেক্সপিয়রের প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দিল। প্রথমে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা লিয়ার’। একে একে বিভাস, কৌশিক, চন্দন। সমসাময়িক চার পরিচালক একই সময়ে শেক্সপিয়র মঞ্চস্থ করছেন, এমনটা আগে ঘটেনি। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক (অধুনা ন্যাশনাল লাইব্রেরির কর্ণধার) স্বপন চক্রবর্তীর বক্তব্য, উনিশ শতকের বাংলা মঞ্চে শেক্সপিয়র দুটি কারণে দর্শক-আনুকূল্য পাননি। প্রথমত, অমিত্রাক্ষর গৈরিশ ছন্দে সাধারণ মানুষ কথা বলত না। দ্বিতীয়ত, দর্শকসমাজ ছিল অন্য রকম, শেক্সপিয়রের নাটকে তারা নিজেদের দেখতে পেত না। ‘বাবু-সংস্কৃতিতে মেয়েরা আদালতে পোর্সিয়ার মতো সওয়াল করতে পারে না, রোজালিন্ডের মতো ছেলে সেজে বেরিয়ে পড়তে পারে না’, বললেন তিনি।
পরিবর্তন? কৌশিক সেনের নাটকে ম্যাকবেথ ও দুই খুনি।
অবস্থাটা বদলায়নি বিশ শতকেও। উৎপল দত্তের ‘ম্যাকবেথ’ গ্রামগঞ্জেই বেশি চলত। বছর পনেরো আগে সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লিয়ার’, সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘কোরিওলেনাস’ মাছি তাড়াত। বাম আমলের শেষ দিকে ‘রাজা লিয়ার’ই জনপ্রিয়তার প্রথম রেকর্ড। ‘নাটক দেখে কেউ ভেবেছিল, বার্ধক্যের অসহায়তা। কেউ বলেছিল, ক্ষমতার অন্ধতা’, বলছেন সুমন।
সমকালীন রাজনীতি ছিল শেক্সপিয়রের নাটকেও। ‘কিং লিয়ার’ প্রথম নামে রাজা প্রথম জেম্সের রাজসভায়। তার আগে লন্ডন উত্তাল ছিল একটি বিষয়ে। রানি এলিজাবেথের পর সিংহাসনে কে? উন্মাদ রাজার পাশাপাশি শেক্সপিয়র তাই নাটকে আর একটা জিনিস নীরবে বুনে দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডকে ভাগ করে সর্বনাশ ডেকে এনো না!
নাটকের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা এই রাজনীতিই পরিচালকদের টেনেছে। কৌশিক, চন্দনরা একবাক্যে জানাচ্ছেন, ‘এখন সরাসরি কিছু বলার চেয়ে শেক্সপিয়রের আড়াল নেওয়াটা অনেক বেশি এফেক্টিভ।’ যেমন, শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক। সেখানে প্রশ্ন একটাই। যাবতীয় ক্ষমতা এক জনের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়া উচিত? ‘ছয় বছর আগে, ২৩৫ বনাম ৩০-এর সময় নাটকটা নামানোর কথা প্রথম আসে’, বলছেন চন্দন।
শেক্সপিয়র তাই দুই ধারওয়ালা ছুরি! যে কোনও প্রেক্ষিতে ব্যবহার করা যায়। ১৯৩৪ সালে প্যারিসে নাটক, ‘কোরিওলেনাস’! অভিজাত কোরিওলেনাস সাধারণ মানুষকে হেয় করেন। নাটক শেষে ‘ফ্যাসিবাদ’ সমর্থনের দায়ে পরিচালক বরখাস্ত। কয়েক মাস পরে, স্তালিনের মস্কোয় সেই নাটক জমে ক্ষীর। কোরিওলেনাস জনগণের শত্রু, সেটাই তাঁর ট্রাজেডি!
বাংলার ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’র অবশ্য প্রশ্ন একটাই। কেন কৌশিক, চন্দনরা শেক্সপিয়রের ওপর কলম চালাবেন? শেক্সপিয়র কিন্তু ‘গুরুদেব’ ছিলেন না। তাঁর নাটকে প্রথম থেকেই অন্যরা কলম চালিয়েছেন। ম্যাকবেথ নাটকে ডাকিনীদের পরি হিসেবে দেখানো হত। পরে টমাস মিডলটন কলম চালিয়ে ডাকিনীদের কুৎসিত, দাড়িওয়ালা মেয়ে করে দিলেন। রুশ পরিচালক স্তানিস্লাভস্কি ‘ওথেলো’ নাটক নামানোর সময় ডায়েরিতে লিখছেন, ‘এমিলিয়ার সঙ্গে ডেসডেমোনার কথোপকথন কেটে দেব? তা হলে আরও নাটকীয় হবে।’
বাঙালি পরিচালক স্তানিস্লাভস্কির মতো দৃশ্য ‘এডিট’ করছেন না। কিন্তু শেক্সপিয়রের শরীরে বুনে দিচ্ছেন নতুন সংলাপ, সমসাময়িকতার ইঙ্গিত। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে দুই খুনি মাঝপথে উধাও! কিন্তু কৌশিকের নাটকে অন্য জিনিস। যে দুই খুনি ম্যাকবেথের নির্দেশে কাজ করত, ক্ষমতা বদলের পর তারাই ম্যালকম, ডোনাল্ডবেন-এর হয়ে কাজ করে। খুনিরা এই ভাবেই ক্ষমতার ‘পরিবর্তন’ মানিয়ে নেয়? প্রতিটি রাজনীতি শেক্সপিয়রকে নিজের ছাঁচে ঢেলে নিয়েছে। কলকাতায় এত দিনে সেই সময় এল।
শেক্সপিয়র জানতেন, দর্শক তার সময়কে নাটকে দেখতে চায়। ‘চতুর্থ হেনরি’ নাটকে শস্তা সরাইখানায় বাহকের দল কথা বলছে। কেউ বলে, ‘আমাকে চ্যেরিং ক্রস অবধি শুয়োরের মাংস পৌঁছে দিতে হবে।’ কেউ বলে, ‘আমার ভাগের টার্কিটা ঠিক ছিল না।’ নাটকের দর্শক চিনে ফেলত তার শহরকে। চতুর্থ হেনরির আমলে ইংল্যান্ড টার্কি চিনত না। নাটকে আজকের কথা বলে দর্শককে কানেক্ট করো শেক্সপিয়রের রাজনীতি।
গিরিশ ঘোষ, অমরেন্দ্রনাথ দত্তদের বাংলা শেক্সপিয়র এই ‘রাজনীতি’র কথা ভাবেনি। বাঙালি তখন শেক্সপিয়রের ভাষায়, চরিত্রচিত্রণে মুগ্ধ। আর আজ? ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটক মনে করতে পারেন। রাজপুত্র হ্যাল রাজকাজে তালিম নেওয়ার বদলে শস্তা পানশালায় সময় কাটায়। উদ্বিগ্ন রাজাকে সভাসদ বলেন, রাজকুমার অন্য এক ভাষা শিখছেন। যে ভাষার অন্ধকারতম গহ্বরের হদিশ জানলে তবেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পরে হ্যাল রাজা পঞ্চম হেনরি হিসাবে শপথ নেন। পানশালার বন্ধু ফলস্টাফকে নির্বাসন দেন। একুশ শতকে আজ মনে হয়, ক্ষমতার চরিত্র এটাই। বন্ধুদের ত্যাগ করে অন্য মুখোশে রাষ্ট্রশাসন।
এখানেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক জোনাথন বেট পরিষ্কার লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ায় যত দিন যুদ্ধ, ধর্ষণ, প্রতিহিংসা ইত্যাদি থাকবে, শেক্সপিয়রের ট্রাজেডিও রয়ে যাবে অম্লান।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.