ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক টিভি শো-তে গিয়া নিজ দেশের ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ হইয়াছেন। ব্রিটেনের প্রখ্যাত দেশাত্মবোধক সংগীতের সুরকারের নাম বলিতে পারেন নাই। ব্রিটিশ রাজপরিবারের এক মহাসনদ স্বাক্ষরের তারিখ সম্পর্কেও অবগত নন, বুঝা গিয়াছে। নিন্দার ঝড় চলিতেছে। যুক্তি বুঝা সহজ। একটি দেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি যদি সেই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ হন, কোন অধিকারে তিনি সেই ইতিহাসেরই অনেকটা জুড়িয়া থাকার প্রত্যাশা করেন? অভিযোগটি আপাত-স্বাভাবিক, কারণ ক্যামেরন এমন পদ অলঙ্কৃত করেন, যাহার দিকে মানুষ সাধারণত বাড়তি শ্রদ্ধা লইয়া তাকাইয়া থাকে এবং সেই পদের অধিকারীকে সামান্য মনুষ্যের মতো ভুলভ্রান্তি-সম্পন্ন বলিয়া ভাবিতে চায় না। যাহাদের অত শ্রদ্ধাভক্তির চাষবাস নাই, তাহারা আবার প্রধানমন্ত্রীকে বিপন্ন করিতে পারিলে সুযোগ ছাড়ে না, তিল-কে বেশ ভয়াবহ পরিমাণ তালে পরিণত করিয়া রাজপথে ফাটাইয়া থাকে। দুই প্রকার মানুষ ও এক প্রকার সংবাদপত্র (দুর্জনে বলে, সংবাদপত্র এক প্রকারেরই হয়, যাহা আটা ও ভূষি আলাদা করে এবং ভূষিটি ছাপে) মিলিয়া সংবাদটিকে বিস্ফারিত চক্ষু ও উল্লসিত দন্ত দিয়া সাজাইয়াছে।
শার্লক হোমস এক বার ওয়াটসন-কে বলেন, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে না পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে, তিনি জানেন না। ওয়াটসন চক্ষু কপালে তুলিলে তিনি বলেন, সেই জ্ঞানের উপযোগিতা কী, যাহা তাঁহার কখনও কোনও কাজে লাগিবে না বা তাঁহার জীবনের কোনও অংশই এতটুকু প্রভাবিত করিবে না? যুক্তিটি প্রথম শ্রবণে হাস্যকর, দ্বিতীয় চিন্তনে মোক্ষম। আফ্রিকা দেশে সেউফল পাওয়া যায় কি না এই লইয়া ভাবিত হইলে যেমন বাঙালি কেরানির জীবন যাপন এক ইঞ্চিও পাল্টাইবার প্রশ্ন উঠে না, তেমনই গোয়েন্দাকে আয়ত্ত করিতে হইবে মানুষ নামক প্রাণীটির চরিত্র ও ব্যবহার বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি, মহাবিশ্বে যে ঘোরাঘুরি হোম্সের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ ভাবে ঘটিয়া চলিতেছে ও চলিবে, তাহা লইয়া মাথা ঘামানো সময়ের ও মস্তিষ্কের অপচয় ভিন্ন আর কিছুই হইবে না। ভাবিলে দেখিব, ক্যামেরনের নিকট হইতে আমরা যে ইতিহাস-জ্ঞান প্রত্যাশা করিতেছি, তাহার প্রকৃত প্রয়োজন তাঁহার কিছুই নাই। তাঁহাকে প্রশাসন চালাইতে হয়, গণতন্ত্রের ঘাঁতঘোঁত বুঝিতে হয়, বাস্তবজ্ঞান ও মনুষ্য-ম্যানেজমেন্ট কৌশল লইয়া বহু প্রবণতার লোকজন সামলাইতে হয়, দেশে কোনও সংকট উপস্থিত হইলে সমাধান খুঁজিতে হয়, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির উত্থানপতনের প্রতি কড়া নজর রাখিতে হয় ও অন্যান্য দেশের প্রধান ব্যক্তিদের সহিত কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করিতে হয়। কোনওটির সঙ্গেই নিজ দেশের মহিমাকীর্তনকারী সংগীতের সুরকারের নাম জানিবার ন্যূনতম সম্পর্ক নাই। সন-তারিখ মুখস্থ থাকিলেই ইতিহাসচেতনা জন্মায়, কে বলিল? বরং সাম্প্রতিক যে কাল প্রবাহিত হইতেছে চারি পাশ দিয়া, তাহা অতি মনোযোগ সহ লক্ষ করা ও তদনুযায়ী কার্য প্রণালী স্থির করাই এক জন প্রকৃত ইতিহাস-অংশী ও সম্ভাব্য ইতিহাস-রচয়িতার কর্তব্য। উনি দেশ সামলাইবেন না দেশের ইতিহাস-পুস্তক খুলিয়া নাম-দেশ-ফুল-ফল উচ্চৈঃস্বরে দুলিয়া দুলিয়া মুখস্থ করিবেন?
আসলে, কতকগুলি উদ্ভট স্বতঃসিদ্ধ মগজে ভরিয়া আমরা ঘুরিয়া বেড়াই। তাহার মধ্যে একটি হইল, গম্ভীর কাজকর্ম করেন যিনি, তাঁহাকে যে কোনও গম্ভীর প্রশ্ন করা যাইতে পারে, উত্তর দিতে না পারিলে তিনি কিছু খাটো হইলেন। ক্রিকেটার যদি ব্র্যাডম্যান-এর গড় না জানেন, আমরা বিস্মিত হই না। জেমস লং সরণি ধরিয়া যে পথচারী প্রত্যহ হাঁটিয়া বাড়ি ফিরেন, তাঁহাকে জেমস লং সম্পর্কে কোনও কঠিন প্রশ্ন করি না। কিন্তু সাহিত্যিককে ডিকেন্সের ঠিকুজি জিজ্ঞাসা করি, গণিতবিদকে আইনস্টাইনের চুলের সংখ্যা। এই অভ্যাসটিই বরং ত্যাগ করা প্রয়োজন। বেচারা ক্যামেরনের হিস্ট্রি-গ্রন্থগুলি তাক হইতে পাড়িবার দরকার নাই। |