|
|
|
|
আমার মন এত ভাল লাগছে কেন |
কোনও আনন্দের সঙ্গেই তুলনা করতে পারি না শরতের। এই আনন্দ বরাবর
আমাকে ঘর
থেকে বাইরে টেনেছে, উধাও হয়ে যেতে প্ররোচনা দিয়েছে। বললেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
কাশফুলের কথা উঠলেই লোকে আজকাল নাক সিঁটকে বলে, মা-ই গড! আবার কাশফুল! শরৎ মানেই কি সেই শিউলি, সেই কাশফুল আর সেই মা দুগ্গা! এ যে বড় একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে মশাই!
কথাটা ঠিক, তবে এ ছাড়া শরৎকালের আর আছেটাই বা কী? ছ্যাড়ছ্যাড়ে বৃষ্টি আর ফিরোজা আকাশ? সে কথাও তো ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রতি বছর লেখা হয়ে আসছে, আর কত?
তা হলে শরতের রূপবর্ণনা দোখিল করা ভারী কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে আমার মতো দুর্বল কলমচির পক্ষে। আর ওই কাশফুল-টাশফুল যেখানে দেখা যায় দেদার, শিউলির খুব রমরমা, আমি সেই গাঁ-গঞ্জ এবং আধা শহরের মানুষ।
সেই ছেলেবেলা থেকেই গোয়েন্দার মতো আমি শরৎকালকে অনুসরণ করে আসছি। এই ম্যাজিকওয়ালার রহস্যটা কী তা ধরবার জন্য আমি তার পোঁটলাপুঁটলি ঝোলা-ঝুড়ি ঘেঁটে দেখেছি বহু বার। আঁতিপাঁতি করে আশপাশের তত্ত্বতালাশ নিয়েছি। নদীর ধার, বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে বা টিলায়, সন্ধ্যায় বা সকালে সূত্রসন্ধান করে করে বয়স বাড়ল। আজও ধরা গেল না এই শরৎ নামক জাদুকরের লুকোনো তাসটা কী।
এই গোয়েন্দাগিরিটাই বা কেন তাও কি ঠিক মতো বুঝিয়ে বলতে পারব? যখন ছোট্টটি ছিলাম, তখনও বুঝতে পারতাম, বছরের এই একটা সময়ে আমি কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাই। শীত-গ্রীষ্ম চেনা হয়ে গেছে, বর্ষাকাল এলে তো মহা আনন্দ, সব ঋতুকেই চেনা লাগে, শুধু এই শরৎকে নয়। শরৎ আসবার একটু আগে থেকেই আমি সতর্ক ও নিঃশব্দ পদক্ষেপ ঠিক টের পেতাম। একটা অত্যাশ্চর্য রোমহর্ষ হত, কী একটা প্রত্যাশায় চনমনে লাগত। ভীষণ উন্মুখ, তৃষ্ণার্তের মতো অপেক্ষায় থাকতাম। ঠিক যেন আমার প্রিয় মিঠাইওয়ালা আসবে তার বাঁক ঘাড়ে করে। মস্ত মাটির গামলায় ঘোলের ওপর ননীর ডেলা ভাসিয়ে। সেই আধ পয়সা বা এক পয়সার এক-একটা ননীর ডেলা চিনি ছড়িয়ে মুখে দিলে গলা থেকে পেট অবধি সম্মোহনে মূক হয়ে যেত। শরৎকালও তাই। |
|
রসনা ছাড়াও যে অন্য কোনও তৃপ্তি থাকতে পারে, সেটার পাঠ বোধহয় আমাকে অবোধ বয়সে প্রথম দিয়েছিল ওই শরৎ নামক জাদুকর। নিপুণ রসায়নে সে মেঘের সঙ্গে রোদ্দুর মিশিয়ে দিত, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামিয়ে পট করে বৃষ্টির লাগাম টেনে এক ধামা রোদ্দুরের হিরে-মানিক ঢেলে দিত চার দিকে। আমি হতচকিত, দিশাহারা হয়ে যেতাম আর নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতাম, আমার মন এত ভাল লাগছে কেন? কেউ তো কোনও নতুন খেলনা বা গল্পের বই দেয়নি! আজ তো বাড়িতে পায়েস রান্না হচ্ছে না! আজ তো আমার সব অঙ্ক রাইট হয়নি! তা হলে কেন কেন কেন এত শিহরন হচ্ছে? কেন পাগলের মতো বাইরে বেরিয়ে দৌড়তে ইচ্ছে করছে? কেন মনে হচ্ছে আজ আমার ছুটির দিন?
প্রতি বছর ওই একটা সময়ে আমাকে পাগলামি পেয়ে বসত। মনে হত, আনন্দে ভিতরটা যেন ফাটো-ফাটো।
আমার সেই বয়সের আনন্দগুলো ছিল বিটকেল রকমের। রাস্তা দিয়ে যে-সব দু’ঘোড়ার ছ্যাকড়া গাড়ি যেত, সেগুলোর পিছনে বাইরের দিকে একটা তক্তামতো আটকানো থাকত। বোধহয় কোচোয়ানের সহকারীর জন্য। এই চলন্ত গাড়ির পিছনে ছুটে তক্তাটায় উঠে বসতে পারলে মনে হত আমি পৃথিবীর রাজা। বিপদও ছিল। হিংসুটে কোচোয়ান টের পেলে তার চাবুকটা পিছনে চালিয়ে দিত। হঠাৎ করে সেটা এসে পড়ত গালে বা মাথায় বা চোখে। তখন লাফিয়ে নেমে দে দৌড়। কিংবা জিত্তাল থেকে মার্বেল জিতে নিলে যে কী বীরের মতো লাগত নিজেকে! কিংবা ভরা বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রের খরস্রোতে বহুদূর সাঁতরে যেতে যেতে যেন সমুদ্রের ডাক আসত কানে। কত সুস্বাদ ছিল করমচায়, কামরাঙায়, টোপাকুলে, কষ্টি পেয়ারা বা কাঁচা আমে। কত আনন্দ ছিল লুটের বাতাসায়, জলে-কাদায়, বুড়ির মাথার পাকাচুলে। কিন্তু কোনও আনন্দের সঙ্গেই তুলনা করতে পারি না শরতের। এই আনন্দ বরাবর আমাকে ঘর থেকে বাইরে টেনেছে, বিবাগী করতে চেয়েছে, নিয়ে যেতে চেয়েছে নিরুদ্দেশে, উধাও হয়ে যেতে প্ররোচনা দিয়েছে। |
|
মফস্সল ছেড়ে অসম, বিহার, পুব ও উত্তর বাংলার পাহাড়-পর্বত, জঙ্গল, মাঠ-ময়দান ছেড়ে যখন প্রকৃতিহীন বাঁধানো কলকাতায় এলাম, ক্লাসঘরে বসে হঠাৎ একদিন টের পেতাম, ঠিক টের পেতাম, অবধারিত বুঝতে পারতাম তার আসার সময় হয়েছে। আসছে সে। কোথাও কাশফুলের চিহ্নমাত্র নেই। শিউলির উন্মনা
গন্ধ পাইনি, রোদে-মেঘে রোমাঞ্চক প্রেমকাহিনিও চোখে পড়ে না, কিন্তু অন্তরের মৃদঙ্গে সে ঠিক ঘা দেয়। অস্থির হই, পাগল হই, বিবাগী হওয়ার ডাক এসে পৌঁছয়। অতি কষ্টে নিজেকে বেঁধে রাখতে হয় সংসার ও গৃহস্থালির সঙ্গে। গৃহবাসী আমি, বৈরাগ্য কি আমাকে মানায়?
মাত্র কয়েকটা দিন সে আমার বয়স কেড়ে নেয়, কেড়ে নেয় আমার যাবতীয় বোধ ও বিবেচনা, চুরি করে আমার সব হিসাব-নিকাশ, আমাকে নিয়ে পুতুলের মতো খেলা করে চলে যায়, চোখে জল আসতে চায়, অকারণ অজানা আনন্দে ভেসে যায় বুক। আজও চেনা হল না তাকে, ধরা গেল না তার ম্যাজিকের কূটকৌশল। ব্যর্থ এই গোয়েন্দা তাই হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করে। ধরা পড়ে যেয়ো না হে বাপু, জাদুবিদ্যে ধরা পড়লে যে আনন্দই মাটি হয়! |
|
|
|
|
|