জম্মু-কাশ্মীরে পঞ্চায়েত সদস্যদের পদত্যাগের হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে। মাত্র বছরখানেক আগে রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সর্বনিম্ন স্তর অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ব্যাপক সাড়া পড়িয়াছিল। সর্বদলীয় হুরিয়ত সম্মেলন সহ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া দলে-দলে কাশ্মীরিরা পঞ্চায়েতে তাঁহাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করিয়াছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় রাজ্যে মোট ৩৪ হাজার পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচিত হন। রাজ্যবাসীর বক্তব্য ছিল, রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভাবে এই সদস্যরা গ্রামের উন্নতির জন্য তৎপর হন, অতএব অন্ধ ভারত-বিরোধিতার নামে নিজেদের উন্নয়নের এই সুযোগ, গ্রামে-গ্রামে বিজলি-পানি-সড়কের জাল ছড়াইয়া দিবার এই সম্ভাবনা হারানো অনুচিত। তৃণমূল স্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাকে লইয়া যাওয়ার গণতন্ত্র সে দিন কাশ্মীরিদের কাছে উৎসবের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। আগামী মাসে পরবর্তী স্তর, অর্থাৎ ব্লক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচনের নির্ঘণ্ট বিজ্ঞাপিত। কিন্তু ১৪৩টি কাউন্সিলের সেই ভোটগ্রহণপর্ব লইয়া সংশয় সৃষ্টি হইয়াছে।
সংশয়ের কারণ জঙ্গিদের হাতে একের পর এক পঞ্চায়েত সদস্যের নিধন এবং ইস্তফা না দিলে সব সদস্যকেই প্রাণনাশের হুমকি। গত এক বছরে জঙ্গি হামলায় মোট আট জন সরপঞ্চ নিহত হইয়াছেন। জঙ্গিরা যে দ্বিতীয় স্তরের পঞ্চায়েতের আসন্ন নির্বাচন বানচাল করিতেই এই হামলা ও হুমকির পথ লইয়াছে, তাহা স্পষ্ট। তাহারা গণতন্ত্রকে ভয় পায়। কেননা এ-ধরনের বন্দোবস্ত সফল হইলে জনসমাজে তাহারা অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িবে। তাই হুমকি, আর সে হুমকি যে বায়বীয় নয়, তাহা প্রতিপন্ন করিতেই হত্যা। এই সন্ত্রাসের কাছে নতিস্বীকারের প্রশ্ন নাই। তবে এটাও ঠিক যে ৩৪ হাজার পঞ্চায়েত সদস্যকে দুইজন করিয়া সশস্ত্র রক্ষী সরবরাহ করাও সম্ভব নয়। অত পুলিশ রাজ্য সরকারের নাই। তাই জনে-জনে রক্ষী সরবরাহের পরিবর্তে সামগ্রিক ভাবে নিরাপত্তার আবহটি উন্নত ও নিশ্ছিদ্র করিতে হইবে। আর যাহা করিতে হইবে, সেটি হইল পঞ্চায়েতের কাছে অবিলম্বে প্রতিশ্রুত ক্ষমতা ও তহবিলের হস্তান্তর। এই হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি যত বিলম্বিত হইবে, সরকার এই বিষয়ে যত টালবাহানা করিবে, তৃণমূল স্তরে উন্নয়নের কর্মকাণ্ডটি ততই বিলম্বিত হইবে। এই বিলম্ব নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলির সামাজিক-রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের পথে অন্তরায় হইতে পারে। তাহাতে জঙ্গিদেরই পোয়াবারো।
জঙ্গিরা সর্বদাই প্রমাণ করিতে চাহিবে যে, পঞ্চায়েতি-রাজ রাজ্যবাসীর উন্নয়নে ফলপ্রসূ হইবার নয়। এ ব্যাপারে তাহাদের সহায় হইতে পারে রাজনীতিকদের দুর্নীতি। জম্মু-কাশ্মীরে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় তহবিল যে ধারাবাহিক অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির কৃষ্ণ-গহ্বরে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে, তাহা অজানা নয়। জওহরলাল নেহরুর কাল হইতেই ইহা চলিয়া আসিতেছে। কাশ্মীরি রাজনীতিকরাও সমাজের উন্নয়ন, রাজ্যের আর্থিক পরিকাঠামোর নির্মাণ অপেক্ষা ব্যক্তিগত সম্পদবৃদ্ধিতে অধিকতর মনোনিবেশ করিয়াছেন। বর্তমানে যিনি রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী, সেই তারা চাঁদ যেমন পঁচিশটি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করিতেছেন, যেখানে নিয়মানুসারে তাঁহার প্রাপ্য দুইটি। রাস্তাঘাট তৈরি, নিকাশি ব্যবস্থা নির্মাণ, পানীয় জলের বন্দেবস্ত, আবাসনসর্ব ক্ষেত্রেই নিকৃষ্ট মানের ইমারতি দ্রব্য ব্যবহৃত হইতেছে, যাহা লইয়া বাসিন্দাদের ক্ষোভ তীব্র। এমনকী হজরতবাল-এর পবিত্র মসজিদের মেরামতিতেও ঠিকাদার-নির্মাতাদের অতিরিক্ত মুনাফার ব্যবস্থা করিতে সরকারি মন্ত্রী-আমলারা জোটবদ্ধ, এমন অভিযোগ ভুরি-ভুরি। নির্বাচিত সরকারের তরফে এ ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও প্রতারণার ঘটনা কিন্তু জঙ্গিদের বিকল্পের সন্ধানকেই বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়। আর তাহাতেই গণতন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি। |