আশঙ্কা ছিলই, তবু চোখের সম্মুখে সেই আশঙ্কা সত্য হইয়া উঠিতে দেখিলে বিপন্নতার বোধ হইতে বাধ্য। কলিকাতা হইতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আন্তর্জাতিক বৈঠক আগরায় সরিয়া গেল, ইহা দেখিয়া পশ্চিমবঙ্গবাসী বিমর্ষ, ত্রস্ত হইবেন, সন্দেহ নাই। বৈঠক পশ্চিমবঙ্গে ঘটিলে তাহাতে এ রাজ্যে কত বিনিয়োগ আসিত, তাহা হয়তো স্পষ্ট নহে। কিন্তু ইহা সত্য, বৈঠকের স্থলটির পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গের উপর বাহিরের বিনিয়োগকারীর আস্থা কমিবার ইঙ্গিত। মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, এই বৈঠক যে কলিকাতায় হইবে তাহাই তিনি জানিতেন না। অর্থাৎ তিনি যে বৈঠক চাহিয়াছিলেন, এমন নহে। ইহার পর তিনি চাহিলেও এমন একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৈঠক কলিকাতায় করিতে পারিবেন কি? লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জন করিতে যাহা করিতে হয়, মুখ্যমন্ত্রী তাহার কী কী করিতে পারিয়াছেন? জমি লইয়া তাঁহার প্রস্তাবিত আইন এখনও পাশ করাইতে পারা যায় নাই, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা না করিবার নীতির জন্য বহু নামীদামি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ হইতে সরিয়া যাইতেছে, শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশই বাড়িতেছে, রাস্তাঘাট, আইনশৃঙ্খলার ক্রমেই অবনতি ঘটিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নামিয়া বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে আন্দোলন করিতেছেন। শিল্পপতিদের নিরাপত্তা লইয়াই প্রশ্ন উঠিয়াছে, তাহাদের লগ্নির নিরাপত্তা তো পরের কথা।
পশ্চিমবঙ্গ তাহার রাজনীতি লইয়া আছে। মুক্ত বাণিজ্যের বিশ্বব্যপী অর্থভাণ্ড হইতে রাজ্যের কিছু লক্ষ্মীলাভ হইবে বলিয়া মনে হয় না। অপর দিকে, বন্ধ কারখানাগুলি খুলিবার যে প্রতিশ্রুতি মমতা দিয়াছিলেন, তাহাও অদ্যবধি অপূর্ণ। ডানলপ তথৈবচ, হলদিয়ায় নিত্য অশান্তি। সরকারি টাকায় শিল্প করিবার সাধও সম্ভবত অঙ্কুরে শুকাইবে। কেন্দ্রীয় সরকার বাণিজ্য বৈঠক সরাইয়া স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছে যে, সমর্থন প্রত্যাহারের সহিত বিশেষ সুযোগ-সুবিধার আশাও ছাড়িতে হইবে। যে সকল কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হইয়াছে, সেখানে ফলকগুলি স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি বহন করিবে। কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মার সিদ্ধান্তে আক্ষেপ করিতে পারা যায়, কিন্তু রাগিবার কারণ নাই। রাজনীতির খেলা এই ভাবেই পরিচালিত হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই খেলায় নূতন নহেন। তিনি জানিয়া-বুঝিয়াই সরকার ছাড়িয়াছেন, আবার রাজনৈতিক ছক মানিয়াই কেন্দ্রের প্রতিহিংসার অভিযোগ করিতেছেন। এখন তাহার ফল ভোগ করিতেছে রাজ্যবাসী।
মমতা সম্প্রতি অভিযোগ করিয়াছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতির জন্য, দুর্নীতিগ্রস্তদের দ্বারা চালিত হইতেছে। এই অভিযোগের সত্যাসত্য অন্যত্র বিচার্য। কিন্তু শিল্পের সম্ভাবনা বন্ধ করিয়া দিয়া তিনি যে পরিস্থিতির উদ্ভব করিয়াছেন, তাহাও কি এক প্রকার দুর্নীতি নহে? যাহা বরাদ্দ হইয়া অপচয় হইয়াছে, চুরি হইয়াছে, তাহাকে সহজেই চিহ্নিত করা যাইতে পারে। তাই তাহার প্রতি ‘দুর্নীতি’ বলিয়া আঙুল তোলা সহজ। কিন্তু যাহা বরাদ্দ হইতে পারিত, কিন্তু হয় নাই, তাহাও তো অপচয়, অপব্যয়। সেই ক্ষতিও তো বড় কম নহে, বরং তাহা বাস্তবিক চুরির অঙ্ককে বহুগুণে ছাড়াইয়া যাইতে পারে। ভ্রান্ত নীতি, অপরিণামদর্শী রাজনীতি, মন্দ পরিকাঠামো, দুষ্কৃতী-তোলাবাজদের অবাধ বিচরণ, এই সকলই এ রাজ্যে শিল্পায়নের লগ্নিকে বারবার ফিরাইয়া দিয়াছে। লক্ষ্মী আজ বিমুখ। সেই সত্য এইবার বিশ্ববাসীর নিকট প্রকট হইয়া পড়িল। |