রাতভর হোম চত্বরেরই প্রায় ৪০ ফুট গভীর কুয়োর ভিতরে গলা পর্যন্ত জলে পড়েছিল আট বছরের বালক। চিৎকার করেও সাড়া পায়নি কারও। সন্ধ্যাতেই হোম কর্তৃপক্ষ তার নিখোঁজ থাকার খবর পান। কিন্তু, হোমেরই কুয়োয় যে সে পড়ে রয়েছে, তা জানতে পেরিয়ে গেল ১২ ঘণ্টা!
এবং বোঝা গেল, গুড়াপ-কাণ্ডের পরেও হোমের হাল ফিরছে না। বিষ্ণুপুর শহরের সরকারি হোম ‘সুমঙ্গলম’ হোমের কুয়োয় ভাগ্যিস তেমন জল ছিল না! তাই মঙ্গলবার সারা রাত কুয়োয় পড়ে থেকেও ছেলেটি প্রাণে বেঁচেছে। আর না বাঁচলে কয়েক দিন হইচই হত। তার পরে আবার সব চুপচাপ। হোম পড়ে থাকত হোমেই।
জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান, ‘সুমঙ্গলম’ হোমের সুপারের অস্ত্রোপচার হওয়ায় জুলাই মাস থেকে তিনি ছুটিতে। জয়পুর ব্লকের সুসহংত শিশুবিকাশ প্রকল্প আধিকারিক অশ্বিনী হাঁসদাকে ভারপ্রাপ্ত সুপার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরও কাজের চাপ রয়েছে। ফলে, মাসখানেক ধরে ২৮ জন কর্মীর ভরসাতেই এই হোমের ৬৪ জন আবাসিক রয়েছে।
তাদেরই এক জন সৈকত দে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আবাসিকদের খাবার দেওয়ার সময় গুনতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, সৈকত নেই। হোমের অ্যাটেনডেন্ট মধুসূদন দত্ত বলেন, “সন্ধ্যা থেকেই হোমের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাই। ভাবতে পারিনি কুয়োর ভিতরে ও পড়ে রয়েছে। এ দিন সকালে কুয়োর ভিতর থেকে গোঙানির শব্দ পেয়ে ওর হদিস মেলে।” স্থানীয় বাসিন্দা প্রভাত রায়, অঞ্জন চৌধুরীরা দড়ি ঝুলিয়ে বালকটিকে তুলে আনেন।
কুয়ো থেকে উদ্ধার হওয়ার পরে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৈকত। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাচ্চাটির দেহের অনেক জায়গা কেটেছে। মাথায় ক্ষতি হয়েছে কি না, জানতে স্ক্যান করা হচ্ছে। সৈকত জানায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঘুরতে যাওয়ার নাম করে হোমেরই এক আবাসিক তাকে ওই কুয়োর কাছে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে তাতে ফেলে দেয়। তার কথায়, “গলা পর্যন্ত ডুবে ছিলাম। চিৎকার করেও সাড়া পাইনি।” বছর দশেকের যে ছেলেটির বিরুদ্ধে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ, এ দিন তার খোঁজও হোমে পাওয়া যায়নি। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) অদীপকুমার রায় এ দিন সন্ধ্যায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন। |
তবে শুধু নজরদারির সমস্যা নয়, আবাসিকদের ক্ষোভ, ‘সুমঙ্গলম’-এ বছরে ছ’টি করে পোশাক ও জুতো দেওয়ার কথা থাকলেও একটির বেশি দেওয়া হয় না। খাবারে মাছ, ডিম দেওয়া হয় না। হোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এমনই নানা অব্যবস্থার অভিযোগ তুলে বুধবার আবাসিকেরা ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে। তাতে সামিল হন কয়েকশো এলাকাবাসী। অবরোধ তুলতে পুলিশ লাঠি চালায়। হোমের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এক আবাসিকের হাত ভাঙে। লাঠির ঘায়ে জখম হন স্থানীয় মড়ার পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান মান্নান খাঁ, তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি সাগর সাউ এবং আরও কিছু আবাসিক। হোমে ঢুকে অ্যাটেনডেন্ট ও ফার্মাসিস্টকে মারধরও করেন কিছু অবরোধকারী।
সম্প্রতি হুগলির গুড়াপের একটি হোমের মানসিক ভারসাম্যহীন আবাসিক যুবতী গুড়িয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় হয়েছে। তৈরি হয়েছে নজরদারি কমিটি। তার পরেও কিছু দিন আগে জলপাইগুড়ির ‘নিজলয়’ হোম থেকে পালিয়ে যায় ১০ জন কিশোরী ও বালিকা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অবহেলা ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে আবাসিকেরা। এ বার সে তালিকায় নাম জুড়ল ‘সুমঙ্গলম’-এর।
প্রশাসনিক ভাবে জেলার হোমগুলির দায়িত্বে থাকা বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) সুশান্ত চক্রবর্তী বলেন, “সারা রাত হোমেরই কুয়োয় ছেলেটা পড়ে থাকল। কর্মীরা তা জানলেন না! এটা পরিষ্কার গাফিলতির ঘটনা।” হোমের অ্যাটেনডেন্ট মধুসূদন দত্ত ও করণিক দীনেশ দে-কে ‘শো-কজ’ করা হয়েছে। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) তথা হোমের ‘ফুড টেন্ডার কমিটি’র চেয়ারম্যানও বলেন, “হোম কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই এই কাণ্ড ঘটেছে।” আবাসিকদের অন্য সমস্যাগুলি খোঁজ নিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক। সৈকতের মা স্বামীবিচ্ছিন্না ও মানসিক ভারসাম্যহীন। বছর দেড়েক আগে প্রশাসনের উদ্যোগে সৈকত ও তার ভাই শুভাশিসকে এই হোমে পাঠানো হয়। বিষ্ণুপুর বাইপাসের বাসিন্দা সৈকতের মাসি অমিতা সেন বলেন, “হোমের ভরসায় দুই ভাইকে রেখেছিলাম। কিন্তু এখানে যা ঘটল, আতঙ্কে রয়েছি।” |