মশার বংশ ধ্বংস করা কঠিন। অথচ মশাবাহিত রোগের দাপাদাপিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় বিকল্প উপায়ের সন্ধানে নেমে ‘আশার আলোকরেখা’ দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অন্তত অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের গবেষণাগারের দুই পরীক্ষা-রিপোর্টে এমনই দাবি করা হয়েছে। এবং দু’ক্ষেত্রেই সাফল্যের মূলে সেই জিন।
কী রকম? অস্ট্রেলিয়ার এক দল বিজ্ঞানীর বক্তব্য: তাঁরা এমন এক ব্যাক্টেরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন, যা এডিস ইজিপ্টাই মশার শরীরে ঢুকলে মশার লালাগ্রন্থিতে ডেঙ্গি-ভাইরাসের প্রজনন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাক্টেরিয়াটির জিন এডিস মশার মধ্যে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতিতে ওই জিনযুক্ত মশা ব্যাপক সংখ্যায় ছেড়ে দিয়ে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়। এই কর্মসূচি সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
আর নেচারেই প্রকাশিত নিবন্ধে ব্রাজিলের এক দল বিজ্ঞানীরও দাবি, একটি বিশেষ জিনযুক্ত এডিস ইজিপ্টাই মশা প্রকৃতিতে ছেড়ে ডেঙ্গি অনেকটা ঠেকানো গিয়েছে। তবে তাঁরা মশার দেহে ডেঙ্গি ভাইরাস-রোধী ব্যাক্টেরিয়া ঢোকাননি। তাঁরা পুরুষ এডিস ইজিপ্টাই মশায় একটি জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তা প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়েছেন। স্ত্রী এডিসের সঙ্গে সেগুলির মিলনের পরে ডিম নিষিক্ত হচ্ছে বটে, কিন্তু বহিরাগত জিনের বাধায় সেই ডিম ফেটে বেরোনো শুককীট পূর্ণতাপ্রাপ্তই হচ্ছে না। ফলে মশার বংশবৃদ্ধি হোঁচট খাচ্ছে।
বস্তুত মশা নির্মূল করা যাবে না ধরে নিয়েই মশার জীবাণুবহন ক্ষমতা কমাতে বিশ্বজুড়ে গবেষণার অন্ত নেই। যেমন, ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই মশার শরীরে নির্দিষ্ট ব্যাক্টেরিয়া ঢুকিয়ে তার প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স ও প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম জীবাণু বহনের ক্ষমতা নষ্টের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাটি গবেষণাগারে সফল হলেও ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত মশাগুলো প্রকৃতিতে সে ভাবে বংশবিস্তার করতে পারেনি। ষাটের দশকে এ দেশে পরীক্ষাগারে সংগৃহীত পুরুষ অ্যানোফিলিসের শরীরে শুক্রাণু তৈরির প্রক্রিয়া নষ্ট করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে ম্যালেরিয়া দমনের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তা-ও সফল হয়নি।
কেন? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ম্যালেরিয়া দমন কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন, এমন এক প্রাক্তন আমলার ব্যাখ্যা, “দেখা গেল, স্ত্রী মশা সঙ্গী বাছার সময়ে ল্যাবে ‘তৈরি’ ওই বিশেষ পুরুষ মশাগুলোকে আমলই দিচ্ছে না! ফলে লাভ হচ্ছে না।” শেষ পর্যন্ত সত্তরের দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। তার পরে এ জাতীয় কোনও প্রকল্প কেন্দ্র হাতে নেয়নি।
তবে অনেকটা সেই পথ ধরে হেঁটে সাফল্যের ইঙ্গিত পেয়েছে ব্রাজিল। সে দেশে ইজিপ্টাই মশা নিয়ে সমীক্ষাকারী দলের প্রধান আলদো মালাভাসি গবেষণাপত্রে বলেছেন, “উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের জুয়াজেইরো শহরে একটি বিশেষ জিনযুক্ত এক কোটি পুরুষ এডিস মশা ছাড়া হয়েছিল। এক বছর পরে শহরটির বিভিন্ন এলাকা থেকে এডিস মশার ডিম এনে গবেষণাগারে দেখা গিয়েছে, ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা শুককীটগুলো পূর্ণতা পাচ্ছে না।”
অর্থাৎ, বিশেষ জিনটির কল্যাণে এডিসের ইজিপ্টাইয়ের ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে পারছে না। এর দরুণ কত এডিস মশা কমলো, কিছু দিনের মধ্যে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ব্রাজিলীয় গবেষকেরা। মালয়েশিয়ার ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকায় ওই বিশেষ মশা ছেড়ে তার ফলাফলও ওঁরা দেখতে চাইছেন। ব্রাজিলের একটি সংস্থা ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক ভাবে জিনযুক্ত মশা ‘তৈরি’ শুরু করেছে।
মেলবোর্নের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের দাবি: এডিস ইজিপ্টাইয়ের দেহে ডেঙ্গি-প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে তাঁরা প্রকৃতিতে সেই মশার সফল প্রজনন ঘটিয়েছেন। নেচারে প্রকাশিত সমীক্ষা-রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়টির ডিন অফ সায়েন্স স্কট ও’নিল ও তাঁর সহ-গবেষকেরা জানিয়েছেন, স্ত্রী এডিসের দেহে ‘ওলবাচিয়া’ নামের একটি ব্যাক্টেরিয়া বা তার জিন থাকলে মশার লালাগ্রন্থিতে ডেঙ্গি-ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। অস্ট্রেলীয় গবেষকেরা ল্যাবরেটরিতে ওই মশার প্রজনন ঘটান। ওলবাচিয়াযুক্ত প্রায় দু’লক্ষ মশা ছাড়া হয় কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের দু’টো জায়গায়। পাঁচ সপ্তাহ পর দু’তল্লাটেই এডিস ইজিপ্টাইয়ের মধ্যে ওলবাচিয়ার জিনের অস্তিত্ব মিলেছে বলে গবেষকদের দাবি।
এবং ও’নিলের আশা, ওই মশককূল এ বার ডেঙ্গি সংক্রমণের পথে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু খোলা জায়গায় সেগুলো ডেঙ্গি-আক্রান্ত কাউকে না কামড়ানো পর্যন্ত পরীক্ষায় ‘চূড়ান্ত’ সাফল্য মিলবে না। কুইন্সল্যান্ডের জনবিরল অঞ্চলে তা সম্ভব নয় বলেই ওঁরা এখন ডেঙ্গিপ্রবণ ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে কাজ করতে চাইছেন। “মানুষের উপরে পরীক্ষাটি সফল হলে ডেঙ্গির এই প্রাকৃতিক দাওয়াই স্বীকৃত হবে।” মন্তব্য ও’নিলের।
শুধু ভিয়েতনাম-ইন্দোনেশিয়া কেন? ভারতে এসেও তো ওঁরা পরীক্ষা চালাতে পারেন!
ঘটনা হল, মেলবোর্নের গবেষণা সম্পর্কে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর বা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা ওয়াকিবহাল নন। তাই তেমন সম্ভাবনার কথা এখনও কারও মনে আসেনি। আর কলকাতার পতঙ্গবিদদের প্রশ্ন: স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এখানে কেন এ ধরনের কাজ হচ্ছে না?
রাজ্যের ডেঙ্গি-পরিস্থিতি দেখতে আসা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের এক সদস্যও সম্প্রতি এই প্রশ্ন তুলে যান। রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভা তো বটেই, খাস স্বাস্থ্য দফতরে পতঙ্গবিদের (এন্টেমোলজিস্ট) সংখ্যা যথেষ্ট নয় কেন, তার ব্যাখ্যাও চেয়েছেন তাঁরা। সাফ জানিয়ে গিয়েছেন, পর্যাপ্ত পতঙ্গবিদ না-থাকার কারণেই বছরভর মশার উপরে নজরদারি করা যাচ্ছে না। রাজ্য সরকার কী করছে?
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, ট্রপিক্যালে পতঙ্গবিদ্যা (এন্টেমোলজি) বিভাগটাই তুলে দিয়ে জৈবপ্রযুক্তি-র সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে! “এডিসের জিন-বৈচিত্র নিয়ে কাজের সুযোগ পেতে গবেষকেরা হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন। কিন্তু সবুজ সঙ্কেত মিলছে না।” বলেছেন ট্রপিক্যালের এক অবসরপ্রাপ্ত এন্টেমোলজিস্ট। আর হাতে গোনা যে ক’জন পতঙ্গবিদ বিভিন্ন পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের অধিকাংশের আক্ষেপ, “চিকিৎসা-গবেষণায় নজর না-দিলে মশা-মাছি বা নানা রোগ জীবাণুর পরিবর
ডেঙ্গি-রোধে সেই বিদেশি গবেষণার ‘আলোকরেখা’ই আপাতত এ দেশের ভরসা!
|