আর যা-ই হোক, প্রকাশ কারাটের পথে হেঁটে হাত পোড়াতে চান না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারাট ২০০৮ সালে সমর্থন তুলে নিলেও ইউপিএ-১ সরকারকে ফেলতে পারেননি। মমতাও জানেন, যতই ইউপিএ-২ সরকারের সংস্কার নীতি ও সিদ্ধান্ত তাঁর না-পসন্দ হোক, সরকার তিনি ফেলতে পারবেন না। তা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় রাজ্যকে কেন্দ্রের সাহায্য নিয়েই চলতে হবে। এখনই সাহায্যের রাস্তা বন্ধ করতে চান না মমতা। তাই মন্ত্রিসভা থেকে সরে আসতে চলেছেন। মঙ্গলবার কেন্দ্রকে তাঁর দেওয়া সময়সীমা শেষ হচ্ছে। সে দিনই দলীয় বৈঠকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেবেন। |
নাটকের শুরু শুক্রবার, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি লগ্নে। অনুষ্ঠান চলার সময় মোবাইলে নজর দেননি মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে রাজভবনের দিকে চলতে শুরু করার সময়েই তাঁর কাছে বার্তা আসে, দিল্লিতে মন্ত্রিসভা বৈঠকে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। রাগে ফেটে পড়েন মমতা। ফোন করে রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কে বলেন, ‘এখনই আহমেদ পটেলকে জানিয়ে দাও, আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমরা এটা পুনর্বিবেচনা করতে বলছি। কংগ্রেস যদি এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে, তা হলে আমরাও চরম রাস্তা বেছে নেব।’ এর পর রাজভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হলে তাঁকেও নিজের অসন্তোষের কথা জানান মমতা। মুকুল রায় তত ক্ষণে আহমেদ পটেলকে জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল মঙ্গলবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা দেওয়া হয় কংগ্রেসকে। মমতা এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে, বৈঠকটা পরের দিনই ডাকতে চাইছিলেন। কিন্তু সোমবার পর্যন্ত প্রণববাবু কলকাতায় আছেন, এ কথা মনে পড়ার পরে বৈঠক পিছিয়ে দেন তিনি। মমতার বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি পদের একটা মর্যাদা আছে। তাই সোমবার প্রণববাবু চলে যাওয়ার পর বৈঠক হোক। আবার সোমবারই বিশ্বকর্মা পুজো। সে কথা মাথায় রেখে শেষ পর্যন্ত বৈঠক ডাকা হয় মঙ্গলবার।
গত কাল প্রণববাবু খড়্গপুর আইআইটি-র সমাবর্তনে যোগ দিতে যান। মুখ্যমন্ত্রীরও তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা কাল অনেক বেশি গুরুত্ব দেন প্রতিবাদ মিছিলে উপস্থিত থাকাকে। তাই আগের দিনই তিনি প্রণববাবুকে জানিয়ে দেন, এটা অশিষ্টাচার নয়। তবে গত কাল রাজভবনে রাজ্যপালের নৈশভোজে মমতা ছিলেন। নৈশভোজের পর আবার তিনি প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক করেন।
এখন যা পরিস্থিতি তাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তৃণমূল যদি সরেও আসে, মমতা কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেসকে মন্ত্রিসভা থেকে বেরতে বলবেন না। কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কিন্তু মানস ভুঁইয়াদের রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নিতে পারে। প্রদেশ নেতৃত্বও সেটা চাইতে পারেন। ফলে রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের কী হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। পঞ্চায়েত ভোটে জোট হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু লোকসভা ভোটের সময়েও যদি জোট বিপন্ন হয়, তাতে দু’পক্ষেরই লোকসান। যাদের লাভ হবে, সেই সিপিএম বরাবরই চায়, কংগ্রেস-তৃণমূল জোটটা যেন ভেঙে যায়।
মমতা কিন্তু মন্ত্রিসভা থেকে সরে এলেও সমর্থন প্রত্যাহারের পথে হাঁটতে নারাজ। কেন? সিপিএম নেতারা বলছেন, মমতার সবটাই নাটক। মন্ত্রীদের বের করে এনে বিরোধিতার তাস খেলছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও রাস্তায় মিছিল করে কেন্দ্র-বিরোধিতার পরিসরটা সিপিএমকে দিতে চাইছেন না। আবার একই সঙ্গে সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে জোটকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছেন এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সরকারের সঙ্গে সম্মুখ সমরেও যেতে চাইছেন না।
মমতা শিবিরের পাল্টা যুক্তি হল, পরমাণু চুক্তি নিয়ে প্রকাশ কারাট সমর্থন প্রত্যাহার করেও সরকার ফেলতে পারেননি। দ্বিতীয় ইউপিএ-জমানায় মমতা আর ‘প্রকাশ কারাট’ হতে চান না। কারণ, মমতার সঙ্গে মুলায়মও যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন, তাতেও মায়াবতীর সমর্থন নিয়ে সরকার টিকে যেতে পারে। কাজেই নীতিগত ভাবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও কৌশলগত ভাবে সমর্থন প্রত্যাহার করছেন না মমতা।
মমতা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আর্থিক সাহায্য বা মাওবাদী দমনের প্রশ্নে কেন্দ্রের সহায়তা নিয়েই চলতে হয় রাজ্যকে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের দেরি আছে। সুতরাং এখনই কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাত এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যেখানে গেলে ফিরে আসার উপায় নেই। এনডিএ জমানায় অনেক বেশি আবেগতাড়িত হয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করেন মমতা। তাতে কিন্তু লোকসানই বেশি হয়েছিল। এখন দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা কংগ্রেসকে ছাড়তে হলেও সংখ্যালঘু ভোটের কারণে (পশ্চিমবঙ্গে যার পরিমাণ ২৯ শতাংশ) এনডিএ-র সঙ্গে যেতে পারবেন না তিনি। এই পরিস্থিতিতে ধাপে ধাপে এগোতে চান মমতা। মন্ত্রীদের সরিয়ে নিয়ে আসার পর আগামী দিনে কংগ্রেস কোন পথে এগোয়, কয়লা কেলেঙ্কারি কী রূপ নেয়, বিজেপি কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং কংগ্রেস কতটা চাপে পড়ে, সে সব দেখে মমতা ২০১৪ সালের আগে তার পরবর্তী রণকৌশলের পথনির্দেশিকা তৈরি করবেন। আর তাই আপাতত তিনি সমর্থন প্রত্যাহারের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করা থেকে নিরস্ত থাকছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাষায়, “রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে। খুচরোয় বিদেশি লগ্নি আসলে গরিব মানুষের উপর তীব্র আঘাত। কৃষক, ছোট দোকানদার, খুচরো বিক্রয়কারী থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবিকায় আঘাত লাগবে।” মমতার কথায়, “মহিলাদের রান্না ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এই সরকার। সেই মূল্যবৃদ্ধিকে তৃণমূল কখনও সমর্থন করতে পারে? মূল্যবৃদ্ধিকে সমর্থন করাটা তৃণমূলের রাজনৈতিক ডিএনএ-তে নেই।” আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে তাঁর বক্তব্য, “ওরাও সংস্কার নিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিচ্ছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের একদা পরামর্শদাতা জোশেফ স্টিগলিৎজের মতো চিন্তাবিদ এই অন্ধ সংস্কারের বিরোধিতা করছেন কেন?”
কংগ্রেস কিন্তু এ বার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। দিন পনেরো আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময়েই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জানিয়ে দেন, এ বার বিদেশি বিনিয়োগ, বিলগ্নিকরণের মতো সংস্কারের রাস্তায় হাঁটবেন তিনি। সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়। বিশেষত, রাহুল গাঁধী এ বিষয়ে মনমোহনকেই সমর্থন জানান। কারণ, রাহুলও মনে করেন, যে ভাবে নতুন প্রজন্ম পরমাণু চুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছিল, ঠিক একই ভাবে তারা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তকেও সমর্থন জানাবে। প্রধানমন্ত্রী তাই এ বার দলের সবুজ সঙ্কেত নিয়েই মাঠে নেমেছেন।
অতীতে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে একাধিক বার কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। মমতার যে হেতু আপত্তি আছেই, তাই এ বার তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কেন্দ্র। এ বিষয়ে অবস্থান বদলাতে চাইছে না মনমোহন সরকার। সে কথা গত কাল যোজনা কমিশনের বৈঠকে নিজেও খুব ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন মঙ্গলবার মমতা কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার। |