আইনের দাবি মেনে হবে ডিএনএ পরীক্ষা
দু’যুগ পরে মা-মেয়ের মিলনে আগাম আগমনী
কেটে গিয়েছে ২২ বছর। প্রায় দু’যুগ পরে মা-মেয়ের দেখা। তবু চিনতে ভুল হল না কারও। মা কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায় আর মেয়ে সঙ্গীতার মিলন হল চোখের জলে।
উমার পিতৃগৃহে আগমনের কিছু আগেই কালীঘাটে কুমারেশ-কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায়ের ঘরে ফিরলেন তাঁদের আত্মজা। শয্যাশায়ী মায়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মেয়ে বললেন, “মাঝেমধ্যেই তোমাকে দেখতে আসব। ভেবো না, তুমি সেরে উঠবে।” আর মায়ের গলায় যেন হিমালয়-জায়ার আর্তি, “এত দিন পরে এলি। ক’টা দিন থেকেই যা না।”
রবিবার অবশ্য থাকা গেল না। কারণ, আইনের দাবি মেনে ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। সঙ্গীতাকে এ দিন শিয়ালদহ আদালতে তোলার পরে বিচারক নির্দেশ দেন, সঙ্গীতা এখন থাকবেন শ্বশুরবাড়িতেই। কাল, মঙ্গলবার আদালতে সঙ্গীতার জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন জানাবে সিআইডি। এর মধ্যে অবশ্য কুমারেশবাবু সঙ্গীতার বাড়িতে এবং সঙ্গীতা কুমারেশবাবুর বাড়িতে যেতে পারবেন। ডিএনএ যাচাইয়ের আগে হৃদয়ের মিলন তো হয়েই গিয়েছে!
খুব সহজ অবশ্য হয়নি সেই মিলন। দীর্ঘ দু’যুগের কষ্টের পথ পেরোতে হয়েছে বাবা-মাকে। কুমারেশবাবু যখন তাঁর মেয়েকে শেষ দেখেছিলেন, তখন সঙ্গীতার বয়স চার। ১৯৯০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নীলরতন সরকার হাসপাতালে মেয়েকে হারিয়ে ফেলেন কৃষ্ণাদেবী। তার পর থেকে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও মেয়ের খোঁজ পাননি মুখোপাধ্যায় দম্পতি। থানা-পুলিশ-আদালত-মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দরবারের পরে মাঠে নামে সিআইডি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধামুয়ার সালকিয়া বাজারে পালক বাবা-মা কমলেশ-সবিতা হালদারের কাছে সঙ্গীতার খোঁজ পায় তারা। তারাই বিবাহিতা সঙ্গীতাকে নিয়ে রবিবার বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছয় শিয়ালদহ আদালতে। সঙ্গে সঙ্গীতার স্বামী গোপাল মণ্ডল এবং যাঁর কাছে এত দিন মানুষ হয়েছেন, সেই কমলেশবাবুর স্ত্রী সবিতা হালদার। সবিতাদেবীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর কয়েক জন আত্মীয়ও। বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। প্রকৃতির চোখেও জল।
বাবা কুমারেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গীতা। পাশে পালক-মা
সবিতা হালদার। শিয়ালদহ আদালতে। —নিজস্ব চিত্র
মেয়ের জন্য সকাল থেকেই শিয়ালদহ আদালতে অপেক্ষা করছিলেন কুমারেশবাবু। শয্যাশায়ী স্ত্রী কৃষ্ণাদেবী আসতে পারেননি। জড়তা কাটিয়ে উঠতে মেয়ে একটু সময় নিলেন। তবে বাবার কোনও দ্বিধা নেই। বুকে টেনে নিলেন মেয়েকে। পাশেই সবিতাদেবী। তাঁর চোখে জল। কুমারেশবাবু, সবিতাদেবী এবং সঙ্গীতা কেউই কিছু ক্ষণ কথা বলতে পারছিলেন না। আবেগ সামলে কুমারেশবাবুই প্রথমে মেয়ের থুতনি ধরে বললেন, “কী রে কিছু বল? কেমন লাগছে তোর?” সঙ্গীতা শুধু বললেন, “বাবা, আবার ডিএনএ টেস্ট কেন? যদি অন্য কিছু বেরোয়, কী হবে?” মেয়েকে আশ্বস্ত করে বাবা বললেন, “ভয় নেই। কিচ্ছু হবে না।”
২২ বছর পরে সিআইডি যে-দিন কুমারেশবাবুকে সঙ্গীতার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখা করিয়ে দেয়, সে-দিনও মেয়েকে চিনতে ভুল করেননি বাবা। কুমারেশবাবু যখন মেয়েকে শেষ দেখেছিলেন, চার বছরের সঙ্গীতা তখন পরত ফ্রক। এত দিনে পরনে সিল্কের শাড়ি, কপালে সিঁদুর নিয়ে যখন সঙ্গীতা বাবার কাছে এলেন, কুমারেশবাবু অবশ্য আগের সস্নেহ আবেগেই বুকে টেনে নেন মেয়েকে। এই ২২ বছরে তাঁর জীবনেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ২২ বছরের আগের যুবক কুমারেশবাবু এখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। ছেড়ে দিয়েছেন ওষুধ ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ। শুধু মেয়েকে খুঁজে বার করবেন বলে।
সন্ধান পর্ব শেষ হয়েছে। কুমারেশবাবু এ দিন আদালত-চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি নিশ্চিত, সঙ্গীতা আমারই মেয়ে। তবে কিছু আইনি জটিলতার কারণেই ডিএনএ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।” পালকপিতা গোপালবাবুর বাড়িতে যে-দিন গেলেন, মেয়েকে চিনতে অসুবিধা হয়নি? কুমারেশবাবু বলেন, “বদলে গিয়েছে তো অনেক কিছুই। কিন্তু মেয়েকে চিনতে কি অসুবিধা হয়? ২২ বছর পরে মেয়েও মায়ের নামটা ঠিক বলতে পেরেছে। মায়ের ছবি দেখে তাকে আবছা চিনতেও পেরেছে।” কুমারেশবাবু বলেন, “মেয়েকে যাঁরা বড় করেছেন, তাঁদের কাছে আমি চিরঋ ণী। আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ওঁরা। সঙ্গীতা শুধু আমার মেয়ে নয়, ওঁদেরও মেয়ে।”
পালিকা মা সবিতাদেবীও বললেন, “ও এখনও আমাদেরই মেয়ে।” মাঝেমধ্যেই জলে ভরে আসছিল তাঁর চোখ। বললেন, “আমার দুই ছেলে। সঙ্গীতাকে নিজের মেয়ের মতো করেই বড় করেছি। বিয়ে দিয়েছি। ছোট্ট মেয়েটা শুধু বলতে পেরেছিল, ওর নাম সঙ্গীতা। নামটা আমরা বদলাইনি। বদলাইনি বলেই বোধ হয় সঙ্গীতা ওর মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারল। আমরা যদি নাম পাল্টে দিতাম, তা হলে হয়তো কোনও দিনই ওর মা-বাবার সন্ধান পাওয়া যেত না।”
সন্ধান পাওয়ার জন্য এন্টালি থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল। চার জনকে গ্রেফতার করা হলেও প্রমাণের অভাবে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। কুমারেশবাবু কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। আদালতের নির্দেশেই ২০১১ সালের নভেম্বরে সঙ্গীতার সন্ধানে নামে সিআইডি। ডায়মন্ড হারবারের কাছে ধামুয়ার সালকিয়া বাজারে হালদার বাড়িতে সঙ্গীতার খোঁজ মেলে। সঙ্গীতাকে বড় করা থেকে বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব পালন করেছেন কমলেশ-সবিতা হালদার। বছর ছয়েক আগে গোপাল মণ্ডল নামে এক জরি ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় সঙ্গীতার।
মা-বাবাকে ফিরে পেয়েছেন। তবে এত দিন যাঁদের কাছে মানুষ হয়েছেন, তাঁদেরও কাছছাড়া করতে রাজি নন সঙ্গীতা। বললেন, “মা-বাবাকে ফিরে পেয়ে আমি খুব খুশি। তবে যাঁরা আমাকে মানুষ করলেন, সেই মা-বাবাকেও কোনও দিন ভুলতে পারব না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.