গাছতলায় আসন পেতে গুরুদক্ষিণার পাঠশালা
খন সময় হবে, গুরুদক্ষিণা চেয়ে নেব, বলে রেখেছিলেন শিক্ষক।
নিলেনও তাই। গুরুবাক্য মান্য করতে এক রকম নিঃসম্বল অবস্থাতেই একটা অবৈতনিক স্কুল খুলে ফেললেন ছাত্র। স্কুলবাড়ি তো জোটেনি, গাছতলাতেই ক্লাস। ছ’বছর পার করে সেই ইস্কুল এখন গোটা অঞ্চলের গর্ব।
মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরে ‘সোলেমান স্যার’কে এক ডাকে চেনেন এলাকার লোক। সারা জীবন ছাত্র পড়ানোই
সোলেমান হক
পৃথ্বীরাজ ঘোষ হাজরা
ধ্যানজ্ঞান। শ্রীকৃষ্ণ চম্পালাল মাহেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বেশ কয়েক বছর হল, অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ছাত্র পড়ানো বন্ধ হয়নি। এলাকায় সোলেমান স্যার-এর কাছে পড়েনি, এমন ছাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
পৃথ্বীরাজ ঘোষ হাজরাও স্কুল জীবনে সোলেমান স্যার-এর কাছেই পড়তেন। বাজারের গা ঘেঁষে মল্লিকপাড়ায় স্যার-এর বাড়ি। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে ইংরেজি পড়তে যাওয়া। দক্ষিণা ছিল সামান্যই। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির পৃথ্বীরাজ সেটুকুও জোগাড় করতে পারেনি। বাবা মারা গিয়েছিলেন, সংসারে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। পৃথ্বীরাজ পড়তে এসে লজ্জায় মাথা গুঁজে বসে থাকত। পড়া শেষ হলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেত, পাছে স্যার-এর সঙ্গে চোখাচোখি হয়! সোলেমান হক লক্ষ করতেন সবই। এক দিন পৃথ্বীরাজকে ডেকে পাঠালেন তিনি।
দিনটা আজও পরিষ্কার মনে আছে পৃথ্বীরাজের। পিঠে হাত রেখে স্যার-এর সেই আশ্বাসবাণী, “কোনও টাকা দিতে হবে না আমায়। তুই নিশ্চিন্তে পড়াশোনা কর!” বিহ্বল পৃথ্বীরাজ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে স্যার-এর ঠোঁটে মুচকি হাসি। হাসতে হাসতেই স্যার বললেন, “তাই বলে ভাবিস না, গুরুদক্ষিণা চাইব না! ঠিক সময় চেয়ে নেব! তখন কিন্তু কোনও ওজর-আপত্তি চলবে না!”
কিন্তু সত্যিই কি গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসবেন স্যার? কী আর চাইবেন? পৃথ্বীরাজ ভেবেছিলেন, কথার কথা! তার পর অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেল। মাধ্যমিক পাশ করার পর স্যারের কাছে পড়তে যাওয়াও ফুরিয়ে গেল! ইসলামপুর কলেজ থেকে স্নাতক হলেন পৃথ্বীরাজ। চাকরিবাকরির খোঁজখবর করার পাশাপাশি টিউশনি পড়িয়ে আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মেরে সময় কাটছিল! এক দিন হঠাৎ বাজারের চায়ের দোকানের সামনে পথ আটকে দাঁড়ালেন সোলেমান স্যার। পৃথ্বীরাজ যেই প্রণাম করতে নিচু হয়েছেন, বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘‘এ বার গুরুদক্ষিণা চাই।’’
গাছতলায় চলছে ক্লাস। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরে ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রাউত ও গৌতম প্রামাণিক।
আকাশ থেকে পড়লেন পৃথ্বীরাজ। “কী গুরুদক্ষিণা, স্যার? আমার কী-ই বা রয়েছে যে দেব?” স্যার বললেন, “আমায় কিছু দিতে হবে না। তোর মতোই আরও বহু ছেলেমেয়ে কষ্ট করে পড়াশোনা করে। এখন তুই তাদের বিনে পয়সায় পড়া!’’
স্যারের কথা অমান্য করার প্রশ্ন নেই! কিন্তু কী ভাবে কী হবে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না পৃথ্বীরাজ। নিজে চাকরি পাননি। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পরে সংসারে নিত্য টানাটানি লেগেইছিল। মা স্নিগ্ধা দেবী স্বাস্থ্য দফতরে একটা কাজ পাওয়ার পরে মা-ছেলে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, খাওয়া-পরার চিন্তাটা গিয়েছে। কিন্তু উদ্বৃত্ত কিছু নেই। বাড়িতে বাড়তি জায়গাও নেই। শেষ পর্যন্ত পাড়াতেই একটা বাড়ির ভাঙা বারান্দায় পৃথ্বীরাজ শুরু করে দিলেন তাঁর অবৈতনিক পাঠশালা। প্রথম ছাত্র হিসেবে জুটল একটি যাযাবর পরিবারের দুই সন্তান এবং স্থানীয় হোটেলের এক শিশুশ্রমিক। মনপ্রাণ ঢেলে তাদের পড়াতে লাগলেন পৃথ্বীরাজ।
খবর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল। আরও কিছু গরিব পরিবার তাদের ছেলেমেয়ে পাঠাল। হইহই করে আয়তনে বাড়তে লাগল পাঠশালা। ভাঙা বারান্দা অচিরেই জায়গা অকুলান হয়ে উঠল। সাতসকাল থেকে বাচ্চাদের দাপাদাপি, বাড়ির মালিকও পছন্দ করছিলেন না। পৃথ্বীরাজের বিদ্যায়তন ঠিকানা বদলে উঠে গেল ইসলামপুর বাজারে, ষষ্ঠীতলার শান বাঁধানো গাছতলায়। ছ’বছর হয়ে গেল। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা? পৃথ্বীরাজের গর্বিত উত্তর “৬০। বেশির ভাগই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া।” অন্নপূর্ণা বেদ যেমন সংসার চালান বেতের ঝুড়ি-কুলো তৈরি করে। তাঁর ছেলে পৃথ্বীরাজের ছাত্র। অন্নপূর্ণা বলেন, “মাস্টারমশায় মন দিয়ে পড়ান, টাকাও নেন না। তরতর করে উন্নতি করেছে ছেলে।” কী রকম? পৃথ্বীরাজের পড়ুয়ারা আসলে সকলেই কোনও না কোনও সরকারি ইস্কুলে পড়ে। কিন্তু বাড়িতে এদের পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কোনও লোক নেই। গাছতলার ইস্কুলে সেই কাজটাই হয়ে যায়। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র করিম শেখ যেমন স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ে। করিমের মা শামসুন্নেহার বিবি বললেন, “আমি পড়াশোনা জানি না। বাড়িতে ছেলেকে কিছুই দেখিয়ে দিতে পারতাম না। এখন রোজ সকালে ওই গাছতলার স্কুলে পাঠাই।” আবুল শেখও তাঁর ছেলেকে গাছতলার স্কুলে পাঠান। “শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে মিড ডে মিল পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে গাছতলার স্কুলে পড়াটা ঝালানো হয়।”
পৃথ্বীরাজের পাঠশালার গুরুত্বটা তাই এক কথায় স্বীকার করছেন মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ ইনসাফ আলি-ও। তাঁর কথায়, “প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদেরই এই সাহায্যটা সব থেকে বেশি দরকার। কারণ বাড়ি থেকে তারা কোনও সাহায্য পায় না। টাকা দিয়ে কোথাও পড়বে, সেটাও সম্ভব নয়।” অতএব গাছতলার ইস্কুলই ভরসা।
পৃথ্বীরাজ এখন পাশে পেয়েছেন কয়েক জন বন্ধুকেও। বিশ্বজিৎ হালদার, সনাতন প্রামাণিক, অবিতা ঘোষ, সঞ্চিতা ঘোষরা এখন গাছতলার বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষক। অবিতা বলেন, “পৃথ্বীদার আবেগই আমাদের টেনে এনেছে।” পড়ুয়ারা বসে গাছতলার শান বাঁধানো বেদিতে। শিক্ষকেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ান। পঞ্চায়েত একটা ব্ল্যাকবোর্ড দিয়েছে। তবু কিছু খরচ তো আছে! সেটা আসে কোথা থেকে? পৃথ্বীরাজ জানান, এলাকার কয়েক জন শিক্ষানুরাগী ওঁদের সাহায্য করেন। “বাকিটা নিজেরাই দিচ্ছি। আমরা কেউ কেউ সন্ধ্যায় টাকা নিয়ে গৃহশিক্ষকতা করি। সেই টাকা খরচ হয় সকালের স্কুলে।”
এই সম্বল নিয়েই ছ’বছর পার করেছে পৃথ্বীরাজের ইস্কুল। বছর তিরিশের পৃথ্বীরাজ এখনও কোনও চাকরি পাননি। চাকরি পেলে কী হবে? পৃথ্বীরাজের মা স্নিগ্ধা দেবী বলেন, “আমার ছেলে যেটুকু পড়াশোনা শিখেছে, সেটা সোলেমান স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। আমি চাইব, সোলেমান স্যারকে দেওয়া কথা থেকে ও কখনও সরে না আসুক! এই স্কুলটা বাঁচুক!” ষষ্ঠীতলার গাছতলায় রোজ সকালে পাখপাখালির কিচিরমিচির ছাপিয়ে যায় ছেলেমেয়েদের পড়া মুখস্থ করার সুর। স্থানীয় বাসিন্দা ধীমান দাসের কথায়, “আমরা প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম, হুজুগ। কিন্তু পৃথ্বীদের নিষ্ঠা সেটা ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছে।” পৃথ্বীরাজ-সঞ্চিতারা নিজেরাও মানছেন, “আমাদের জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে গিয়েছে এই সকালবেলার পড়ানো।”
গুরুদক্ষিণা পেয়ে সোলেমান স্যার খুশি তো? অনাবিল হাসি বৃ্দ্ধের মুখে। বললেন, “আমি আসলে এক ঢিলে অনেক পাখি মেরেছি!”
সোলেমান স্যার নিজেও তো মাঝেমাঝেই চলে আসেন ছাত্রের পাঠশালায়! এক দিন এসে দেখেন, বৃষ্টিতে ভিজছে পড়ুয়া আর মাস্টারেরা সবাই। সেই থেকে সোলেমান স্যার ঠিক করেছেন, অন্য কোনও প্রাক্তন ছাত্রকে বলবেন পৃথ্বীরাজদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে। ইনসাফ আলিও আশ্বাস দিয়েছেন, “চেষ্টা করছি ওদের জন্য নিয়মিত কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.