১৯২২ সালের ১৩ মার্চ দোলপূর্ণিমার তিথিতে আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম। তাহার পর নব্বই বছর কাটিয়া গিয়াছে। শতবর্ষের অদূরে উপনীত এই সংবাদপত্র আজ হইতে এক সমভাষী সহযাত্রী লাভ করিল, ইহা আমাদের পরম শ্লাঘার কারণ। গর্ব ও আনন্দের সহিত আমরা ‘এবেলা’র জন্মসংবাদ ঘোষণা করিতেছি। বিশ্বকর্মা পূজাকে বাংলায় শারদীয় উৎসবের সূচনাবিন্দু হিসাবে গণ্য করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম তথা সংস্কৃতির জগতে অবিসংবাদিত অগ্রপথিক এবিপি সংস্থা’র দ্বিতীয় দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ কেবল এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নয়, কেবল সংবাদমাধ্যমের পক্ষেও নয়, সমগ্র রাজ্য তথা সমাজের পক্ষেই এক অসামান্য উৎসবের লগ্ন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিতে আমরা আমাদের সদ্যোজাত সঙ্গীকে সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানাই এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করি। তাহার সঙ্গে সঙ্গে এই অবকাশে আমাদের সমস্ত পাঠক, অনুরাগী, সহযোগী ও শুভানুধ্যায়ীর নিকট আশীর্বাদ যাচ্ঞা করি। দীর্ঘ নব্বই বছর যাবৎ আমরা আপনাদের অকুণ্ঠ আনুকূল্য লাভ করিয়া আসিতেছি। আজ আমরা যেটুকু সাফল্য অর্জন করিতে পারিয়াছি, আপনাদের সহযোগিতা ভিন্ন তাহা কখনওই সম্ভব হইত না। এবেলা’র যাত্রারম্ভে আমরা তাহাকে সঙ্গে লইয়া আপনাদের সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতা প্রার্থনা করি।
কেন দ্বিতীয় একটি সংবাদপত্র? উত্তর সহজ। যুগ বদলাইতেছে। সেই পরিবর্তন গত দুই দশকে এক অভূতপূর্ব গতি এবং মাত্রা অর্জন করিয়াছে। আনন্দবাজার পত্রিকা স্বভাবতই তাহাকে স্বাগত জানায়। এই পত্রিকা তাহার নয় দশকের অভিযাত্রায় আপনাকে নিরন্তর বদলাইয়া চলিতেছে। চিন্তার আদর্শ, সাংবাদিকতার নীতি ও পদ্ধতি, বাংলা ভাষার শৈলী ও প্রযুক্তি সর্ব বিষয়ে সে নিরলস ভাবে অগ্রবর্তী থাকিয়াছে। সমকাল এবং সমাজ হইতে অগ্রসর থাকাই তাহার ধর্ম। আমরা সেই স্বধর্মে ভবিষ্যতেও সুস্থিত থাকিব, তাহা আমাদের সঙ্কল্প। এবং সেই পরিবর্তনশীলতার অঙ্গ হিসাবেই আমরা এই দ্রুত-পরিবর্তনশীল নূতন ও তরুণ দুনিয়ায় একটি নূতন ও তরুণ সংবাদপত্রকে বরণ করিয়া লইতেছি। তাহার নৈতিক আদর্শ এবং মূল্যবোধ অবশ্যই আনন্দবাজার পত্রিকার সহিত অভিন্ন হইবে, সেই নীতির প্রতি তাহার নিষ্ঠা হইবে সমান ভাবে অকম্প ও অবিচল। কিন্তু এবেলা তাহার চার পাশের পৃথিবীকে তাহার মতো করিয়া দেখিবে, বুঝিবে, বিচার করিবে। আমাদের আশা এবং বিশ্বাস, সেই নিজস্ব ও স্বতন্ত্র চিন্তাযাপনের মধ্য দিয়া এই নবীন সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিযোগী হইয়া উঠিবে। প্রতিযোগিতার মাহাত্ম্যে আমাদের গভীর বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর এই ধারণা আমরা প্রবল ভাবে সমর্থন করি যে, প্রতিযোগিতার সুফল ভোগ করিয়া সমস্ত প্রতিযোগীই সমৃদ্ধি অর্জন করিতে পারে। বস্তুত, আমাদের যদি কোনও ঈশ্বর থাকেন, তাঁহার নাম প্রতিযোগিতা মুক্ত, অবাধ, স্বাধীন প্রতিযোগিতা। আমরা প্রতিযোগী অনুজকে সসম্মান অভ্যর্থনা জানাই।
বঙ্গসমাজের পক্ষেও এই নবীন সংবাদপত্রটির আবির্ভাব এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সমাজ এক সঙ্কটের মধ্যে রহিয়াছে। উভয়সঙ্কট বলিলে ভুল হইবে না। এক দিকে সে আপন ঐতিহ্যে আস্থা হারাইতেছে, অন্য দিকে নূতন চিন্তার সাহসেও তাহার ঘাটতি। তাহার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি উত্তরোত্তর পরধর্মে আকৃষ্ট হইতেছে। ভাষায়, পোশাকে, খাদ্যে, আচরণে, সর্ব বিষয়ে বাঙালির রুচি ও পছন্দ তাহার আপন শিকড় হইতে বিচ্যুত হইতেছে, অর্থকৌলীন্যের নিকট আপন স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিতে তাহার আপত্তি নাই। আমরা মনে করি, ইহা আত্মঘাতের পথ। আমরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই আত্মঘাতী বাঙালিকে সচেতন করিতে সচেষ্ট থাকিয়াছি। থাকিবও। উদার, শিক্ষাদীপ্ত, আন্তর্জাতিকতায় উদ্বুদ্ধ দ্বিভাষিক বাঙালি এক দিন জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লইয়াছিল। আমাদের সাধনা সেই গৌরব পুনরুদ্ধারের সাধনা। এই বৃহৎ বাঙালির আত্ম-অন্বেষায় আমরা আমাদের নূতন সহযাত্রীকে আরও এক বার স্বাগত জানাই। |