সকাল পৌনে এগারোটা, চিপক...
স্লিপ কর্ডনের দিকে তাক করে ব্যাট উঁচিয়ে ডানকান ফ্লেচার। মনোজ-সহবাগ-বিরাটের পাশে সওয়া ছ’ফুটের চেহারাটাও স্লিপে দাঁড়িয়ে। বেশির ভাগ বলগুলো উড়ে যাচ্ছে সে দিকেই। দ্বিতীয় ‘অভিষেক’-এর আগে অগ্নিপরীক্ষা আর কী। সওয়া ছ’ফুটের শরীরে অতীতের ছিপছিপে সেই ব্যাপারটা এখন নেই। চেহারাটা বরং একটু ভারীর দিকেই। কিন্তু ‘রিফ্লেক্স’? সেটা তো অন্য কথা বলছে। ক্রিকেটজীবন থেকে দশ মাসের ‘নির্বাসনে’ও তাতে একটুও মরচে পড়েনি। ম্যাচের পর ম্যাচে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যে ক্ষিপ্রতায় বল দেখলে এক সময় উড়ে যেতেন, স্লিপে ক্যাচ প্র্যাক্টিসেও আজ সেই একই দৃশ্যের ‘রিপিট টেলিকাস্ট’! এবং স্লিপে তাঁর ডাইভের বহর দেখে টিম ইন্ডিয়া-র সাহেব কোচকেও বার কয়েক ছুটে আসতে হল।
যুবরাজ সিংহের ফুসফুসে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ধরা পড়েছিল না? ‘সেমিটোমা’ না কী যেন একটা খটমট নাম!
দুপুর সাড়ে বারোটা, ভারতীয় নেট...
এক দিক থেকে দু’জনেরই এটা ‘কামব্যাক’। প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপট দু’জনের আলাদা বটে, কিন্তু লক্ষ্য এক। আর নেটে যখন মুখোমুখি দুই ‘বুভুক্ষু’ পঞ্জাবপুত্তর, আগুন না জ্বলে পারে? হরভজন সিংহের ‘দুসরা’টা ধরতে পারেননি যুবরাজ। সম্মানেও একটু লাগল বোধহয়। পরেরটাই যে ভাবে স্টেপ আউট করে ফেলে দিলেন! ‘স্কুপ’, ‘গ্লান্স’, কভার ড্রাইভগুলো এর পর নিয়ম করে বেরোল একে একে। ডাক্তাররা তাঁকে সাবধান করছেন বারবার। বলছেন, কেমোথেরাপির সাইড এফেক্ট ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি’। বেশি খাটাখাটনি করলে ‘ফেটিগ সিনড্রোমে’ ভুগতে পারেন যুবি। ডাক্তাররা বলছেন বটে, কিন্তু শুনছে কে? বরং চেন্নাইয়ের নেটে তাঁর ব্যাটের অফুরন্ত প্রাণশক্তি দেখলে মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে।
চেন্নাইয়ের দুপুরে নেটে উল্টো দিকে কাকে দেখছিলেন যুবরাজ? হরভজন, নাকি ছয় ছক্কা খাওয়া স্টুয়ার্ট ব্রড? |
বেলা দেড়টা, গন্তব্য ড্রেসিংরুম...
গায়ে অনবরত খোঁচা দিচ্ছে অটোগ্রাফের খাতা। নাকের ডগায় ‘বুম’ ধরে আরও একটা ‘কোট’-এর আশায় হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে সর্বভারতীয় প্রচারমাধ্যম। কিন্তু ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ অদ্ভুত নির্লিপ্ত। মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে আকাশের দিকে। যেখানে তখন মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলছে। সাংবাদিকদের ভিড়ে আটকে পড়ে একবার অস্ফুটে বলে ফেললেন, “আশা করি এখানে ম্যাচটা হবে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে একটা ম্যাচ খেলা দরকার আমার।”
কে জানত, তাঁর প্রত্যাবর্তনের ‘রাউন্ড টু’-তেও শেষ পর্যন্ত বিপক্ষ দাঁড়াবে বৃষ্টি! সোমবারের দুপুর পর্যন্ত চেন্নাইয়ে খটখটে রোদ। কিন্তু তাতে কী? সন্ধে থেকে মেঘের গর্জন এবং অঝোরে বর্ষণ দু’টোই চলল পাল্লা দিয়ে। তামিলনাড়ু ক্রিকেটকর্তাদের মুখও আচমকা শুকিয়ে আমসি। সকালের দিকে যাঁরা বলছিলেন, টানা তিন ঘণ্টা বৃষ্টি হলেও মাঠ শুকিয়ে ফেলা যাবে, বিকেলে তাঁরাই খোঁজ নিতে বসলেন মঙ্গলবারের আবহাওয়ার রিপোর্ট নিয়ে। পূর্বাভাস বিশেষ সুবিধের নয়। বলা হচ্ছে, মঙ্গলবার বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বর্ষণের যথেষ্ট সম্ভাবনা।
এমনিতে যুবরাজ নিয়ে বিশাখাপত্তনমের ‘জোশ’ চেন্নাইয়ে নেই। মাঠ ভরবে কি না সন্দেহ। চল্লিশ হাজারের চিপকে বারো হাজার সিট এমনিতেই বাদ। সরকারের সঙ্গে ক্রিকেটসংস্থার ঝামেলার খেসারতে। আসন সংখ্যা আঠাশ হাজার, কিন্তু চেন্নাই কর্তাদের হিসেব বলছে কুড়ি হাজারের বেশি লোক হবে না। যুবরাজের জন্য বাড়তি কোনও আয়োজনের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে না। সরকারি ভাবে যদিও বলা হচ্ছে, স্মারক-সংবর্ধনা দিয়ে আবেগঘন পরিবেশ তৈরির রাস্তায় হাঁটতে চায় না চেন্নাই। কারণ যুবি যে মারণরোগকে নিপাত করে ফিরেছেন, এটা নাকি তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সেটা নেহাতই কথার কথা। বোর্ডের রাঘববোয়ালরা কেউ আসছেন না। থাকার মধ্যে শুধু গুটিকয়েক প্রাক্তন ক্রিকেটার।
তবে বহিরঙ্গ আর অন্দরমহলের মেজাজে যেমন মাঝে মাঝে তফাত থাকে, এখানেও আছে। চেন্নাই উদাসীন থাকতে পারে, কিন্তু ধোনিদের হেঁসেলে যুবি-আবেগে ভাঁটা নেই। ‘ইউ উই ক্যান’ নামের যে ক্যানসার ফাউন্ডেশন খুলেছেন যুবরাজ, তার ‘লোগো’ মঙ্গলবার ম্যাচে ভারতীয়দের জার্সিতে থাকবে। আবেগে ইন্ধনের এখানেই ইতি নয়। যুবরাজ নিজেও ওই একই ‘লোগো’ নিজের ব্যাটে লাগিয়ে নামছেন। যেন মিনিটে মিনিটে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকে মনে করিয়ে দেওয়া, ‘আমি পারলে তোমরাও পারবে।’ টুইটারে শেন ওয়ার্নের সঙ্গে খুনসুটি চালিয়েছেন দিনভর। ওয়ার্ন লিখছেন, ‘কী হে, মাঠের বাইরে আবার থাকতে কেমন লাগল? ক্রিকেট তোমাকে মিস করল চ্যাম্পিয়ন।’ সঙ্গে সঙ্গে যুবির পাল্টা টুইট, ‘তোমার কথা শুনে ভাল লাগল শেন। দুর্ভাগ্য, ম্যাচটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল। কাল খেলছি।’
আর এই ‘কাল খেলছি’-র ঘোষণায় ঢাকা পড়ছে বাকি সব। চেন্নাইয়ের ঘরের ছেলে বালাজির তিন বছর পর দেশের জার্সিতে ফিরে আসা। প্র্যাক্টিসে না আসায় অশোক দিন্দাকে নিয়ে ছোটখাটো বিতর্ক (টিম জানাচ্ছে ঐচ্ছিক প্র্যাক্টিস, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে জাহির-বালাজিরা যেখানে উপস্থিত সেখানে সম্পূর্ণ সুস্থ দিন্দা থাকবেন না কেন)। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে শেষ বারের মতো নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে নিজেদের মেপে নেওয়ার সুযোগ। সব কিছু যেন পিছনের সারিতে। মা শবনম সিংহ-সহ যুবরাজের কুড়ি জন বন্ধু-বান্ধব আজ চিপকে থাকছেন। যে মাঠ আবার যুবরাজের কাছে অত্যন্ত পয়া। ভারতের হয়ে ৪ ম্যাচে মোট রান ১৯৪। গড় ৯৭। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেষ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিটাও তাঁর এই মাঠেই। ‘পয়া’ মাঠে আরও একটা ‘যুবি-ঝড়’? প্রকৃতির ঝড়-বাদলা না ডোবালে আশাটা কি অন্যায় হবে? |