একটি গোটা অধিবেশনের তিন-চতুর্থাংশ সংসদ অচল করিয়া রাখিবার পর বিরোধী দলের নেতা যখন বলেন যে ইহাও গণতন্ত্রের একটি প্রকাশভঙ্গি, তখন বুঝিতে হয়, ভারতে গণতন্ত্র ছড়াইয়াছে বটে, কিন্তু বোধের ভূমিতে প্রবিষ্ট হয় নাই। নচেৎ, দেশের উচ্চতম গণতান্ত্রিক সভার নির্বাচিত সদস্যরা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তটি বিস্মৃত হইতেন না। এই বিস্মরণ উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রীও উদ্বিগ্ন। বাদল অধিবেশনের শেষ লগ্নে তিনি জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়াছেন, তাহা বিধিবদ্ধ ছিল না, তাঁহার বহুচর্চিত নীরবতার অভ্যাসের সহিত সঙ্গতিপূর্ণও নহে। তিনি সাংসদদের প্রাথমিক দায়িত্ব হইতে বিচ্যুতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাহিয়াছেন। সংসদ বিতর্কের পরিসর। সাংসদরা ব্যক্তিমাত্র নহেন, তাঁহারা যে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁহাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা উচ্চতম গণতান্ত্রিক পরিসরে তুলিয়া আনিবেন, প্রতিটি প্রশ্নকে বিতর্কের মাধ্যমে তাহার যৌক্তিক সীমায় পৌঁছাইয়া দিবেন, তাহাই বিধেয়। স্বভাবতই বিরোধ থাকিবে। এই বিরোধ গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কিন্তু, গণতন্ত্রের পরিসরে সেই বিরোধের মীমাংসা বিতর্কের মাধ্যমেই হইবে বিতর্কের অবকাশ না রাখিবার মাধ্যমে নহে।
মেঠো রাজনীতির সহিত সংসদীয় রাজনীতির দূরত্ব বহু যোজন। রাজনীতিকরা প্রমাণ করিতেছেন, তাহা অনতিক্রম্য নহে। সংসদকে মাঠে নামাইবার প্রক্রিয়া সরল গলার জোরে অপরের বলিবার অধিকার হরণ করিতে পারিলেই কার্য সম্পন্ন হয়। ইউ পি এ’র দ্বিতীয় দফায় বিরোধীরা এই কাজটিতে সিদ্ধহস্ত হইয়াছেন। কয়লা হউক বা টু জি স্পেকট্রাম, সংসদ অচল করাই তাঁহাদের প্রধান কর্তব্য হইয়াছে। কংগ্রেসও ইহার দায় এড়াইতে পারে না, বিরোধী থাকাকালীন তাহারাও এই খেলায় নাম লিখাইয়াছিল। রাজনীতিকরা ধরিয়া লইয়াছেন, মানুষ একটিই ভাষা বোঝে রাস্তার রাজনীতির ভাষা। কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট লইয়া যুক্তিসঙ্গত তর্ক করিলে তাহা বুঝিবার ক্ষমতা ভারতীয় ভোটারদের নাই। মানুষ যদি না-ই বোঝে, তবে আর বিরোধিতায় লাভ কী? ফলে, (তাঁহাদের ধারণায়) মানুষ যে ভাষা বোঝে, তাঁহারা সেই ভাষাকেই রাজনীতির রাষ্ট্রভাষা মানিয়াছেন। পক্ষান্তরে, মানুষও এই ইতর ভাষাতেই অভ্যস্ত হইতেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে অধিকতর লজ্জার আর কিছু নাই।
রাজনীতিতে যদি একটিমাত্র স্বরই থাকে, তবে গণতন্ত্রের থাকা না-থাকায় কিছু আসে যায় না। রাজনীতি যখন বহুধা হয়, তখনই গণতন্ত্রের পরিসরটি অধিক জরুরি হইয়া উঠে। যে গোষ্ঠীর সংখ্যার জোর নাই, গলার জোর নাই, একমাত্র সংসদীয় গণতন্ত্রই তাহাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমান বাক্-অধিকার দিতে পারে। ভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলি যত শক্তিশালী হইয়াছে, সংসদে বহুস্বরের অবকাশও ততই বাড়িয়াছে। যে জনগোষ্ঠীর কথা রাজনীতি পূর্বে স্বচ্ছন্দে ভুলিয়া থাকিতে পারিত, এই দলগুলি তাহাদের মূলধারায় আনিয়াছে। মাঠের রাজনীতির খেলায় যদি এই জনগোষ্ঠীগুলির কণ্ঠ ফের রুদ্ধ হয়, তাহা গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য। দেশেরও। যে বিরোধীরা সংসদে ‘চাক্কা-জ্যাম’-এর রাজনীতির কারবার করিতেছেন, তাঁহারা স্মরণে রাখুন, গণতন্ত্র যতখানি শাসকের, তাহার অপেক্ষা ঢের বেশি বিরোধীর। গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করিলে তাহাতে শাসক অপেক্ষা বিরোধীর ক্ষতিই বেশি। স্বল্পমেয়াদি লাভের কথা ভাবিয়া এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করিলে ভবিষ্যৎকে তাহার মূল্য চুকাইতে হইবে। অবশ্য সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতের রাজনীতি আর কবেই বা দেশের ও জাতির ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়াছে! |