প্রথম নয়, দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় বেহালার প্যারিসপাড়ার ভট্টাচার্য বাড়িতে হানা দিতে পেরেছিল মুন্না ঢালি ও তার তিন সঙ্গী।
ধৃত চার অভিযুক্তকে জেরা করে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ঘটনার দু’দিন আগে, ৪ সেপ্টেম্বর তারা প্রথম বার ভট্টাচার্য বাড়িতে হানা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, ওই দিন মুন্না যখন ভট্টাচার্য বাড়িতে ঢোকে, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন শুকদেব নামে এক ব্যক্তি। তিনি গৌরীদেবীর কেব্ল সংস্থারই কর্মী। একই সময়ে সহকর্মীকে ওই জায়গায় দেখে সে দিনের মতো পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মুন্না। বাইরে অপেক্ষারত শাগরেদদেরও ফিরে যেতে বলে সে। এর পরেই তারা ফের ৬ সেপ্টেম্বর ওই বাড়িতে হানা দেওয়ার ছক কষে।
তদন্তকারীদের দাবি, মুন্না ও তার তিন সঙ্গী জেরায় জানিয়েছে, ঘটনার প্রায় এক মাস আগে গৌরী ভট্টাচার্যের বাড়িতে হানার ছক কষা হয়। পরিকল্পনা করে মুন্না নিজে। তার পাড়ার ছেলে, পেশায় রাজমিস্ত্রি নব ঢালিকে প্রথম সে বিষয়টি জানায়। নব তার পেশাগত সঙ্গী সাত্তার মোল্লাকেও সঙ্গে নেয়। মুন্না দলে টানে তার প্রাক্তন সহকর্মী বিজয় ওরফে রাজেশ দাসকেও। চার জন মিলে ঢালিপাড়ায় মদ্যপান করতে করতে চূড়ান্ত করে ফেলে, ৪ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টা নাগাদ প্যারিসপাড়ায় গৌরীদেবীর বাড়িতে হানা দেওয়া হবে।
গোয়েন্দারা জানান, মুন্না ৪ তারিখ বেলা ১১টা নাগাদ ওই বাড়িতে ঢোকে। ছুরি নিয়ে বিজয়, সাত্তার ও নব তখন ভট্টাচার্য বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছিল। ঠিক ছিল, সুযোগ বুঝে মুন্না নিজের মোবাইল থেকে একটি ‘মিস্ড কল’ করবে বিজয়ের ফোনে। তার পরেই ওই তিন জন বাড়িতে ঢুকবে। কিন্তু সে দিন দীপকবাবুদের বাড়িতে ঢুকে মুন্না দেখে, গ্রাহকদের বাড়িতে বসানোর জন্য ‘সেট টপ বক্স’ নিতে সেখানে উপস্থিত তারই সহকর্মী শুকদেব। তা দেখেই সে দিনের মতো পরিকল্পনা বাতিল করে মুন্না। সন্দেহ এড়াতে সটান উঠে যায় দোতলায়। গৌরীদেবীর কাছে হাজার দেড়েক টাকা ধার চায় সে। কিন্তু গৌরীদেবী তা দেননি। এর পরেই ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় মুন্না। সে দিনের মতো পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। ঠিক হয়, দু’দিন পরেই হানা দেবে তারা।
এর দু’দিন পরে, ৬ তারিখ দু’টি ছুরি দিয়ে চার জনের গলা কেটে খুন করা হয়। ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছিল, খুনের পরে তারা অস্ত্র ছুড়ে ফেলে দেয় আমতলার কাছে কোনও একটি জায়গায়। সোমবার মুন্নাদের নিয়ে ওই এলাকায় যায় পুলিশ। ধৃতদের চিনিয়ে দেওয়া খালে এবং পুকুরে ডুবুরি নামিয়ে অস্ত্রগুলি উদ্ধার করা হয়। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “আমতলার কাছে কুলিপাড়া খাল থেকে দু’টি ছুরি মিলেছে। ওই এলাকার দাসপুরের একটি পুকুর থেকে একটি স্ক্রু-ড্রাইভারও মিলেছে।”
পুলিশ সূত্রের খবর, উদ্ধার হওয়া ছুরিগুলির একটি সাড়ে ন’ইঞ্চি ও অন্যটি সাড়ে আট ইঞ্চি লম্বা। এমন ছুরি সাধারণত মাংসের দোকানে ব্যবহৃত হয়। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ছুরি দু’টি কেনা হয়েছিল আমতলার কাছে একটি দোকান থেকে। ওই দোকানদার বিজয়ের পরিচিত।
খুনের পরে রক্তের দাগ মুছতে চার জনই জামাকাপড় পরে ভট্টাচার্য বাড়ির শৌচাগারে স্নান করেছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। তার পরে ভেজা পোশাকেই তারা ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। তাই ভেজা জামাকাপড়ে তাদের দেখে কারও সন্দেহ হয়নি। পরে ঢালিপাড়ায় মুন্নার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে রক্তের দাগ লাগা একটি স্যান্ডো গেঞ্জি গোয়েন্দারা উদ্ধার করেছেন। পুলিশ জানায়, ঘটনার পরে চার জন আর কখনও একত্রে থাকেনি। তবে শুক্রবার একই পাড়ায় নবর বাড়িতে গিয়েছিল মুন্না। পুলিশ গ্রেফতার করার আগে চার জনের মিলিত না-হওয়ার কারণ হিসেবে গোয়েন্দাদের মুন্না জানিয়েছে, প্রত্যাশিত টাকাপয়সা ভট্টাচার্য বাড়ি থেকে না-পাওয়ায় সবাই মিলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার প্রয়োজন হয়নি।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রাথমিক অবস্থায় জেরার মুখে ধরা পড়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে মুন্না তদন্তকারীদের ভুল পথে চালিত করতে অপরাধের মূল চক্রী হিসেবে গৌরীদেবীর কেব্ল সংস্থার ম্যানেজার অজিত সেনাপতির নাম বলে। কিন্তু গোয়েন্দারা মুন্নার উপস্থিতিতেই অজিতবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝতে পারেন, সে মিথ্যা বলেছে। পরে অবশ্য মুন্না ভেঙে পড়ে। সে জানায়, অপরাধে জড়িত শুধু তারা চার জনই। সে নিজে মূল চক্রী। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, কয়েক লক্ষ না-হলেও কিছু পরিমাণ টাকা ভট্টাচার্য বাড়ি থেকে অবশ্যই লুঠ করেছে তারা। কিন্তু লুঠ হওয়া টাকার পরিমাণ কত, তা গোয়েন্দাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ওই দিন কত টাকা গৌরীদেবীর ঘরে থাকতে পারে, তার সম্ভাব্য হিসেব কেব্ল সংস্থার ম্যানেজারের কাছে চেয়েছেন গোয়েন্দারা। |