চরিত্রটি একটি কিংবদন্তির। মূল কাহিনিও এক। সেই আধারেই ধ্রুপদী নাট্যকারদের একের পর এক নাটক।
রাজা অয়দিপস।
গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেসের নাটকটি ‘রাজা অয়দিপাউস’ নামে ষাটের দশকে কলকাতায় প্রযোজনা করেছিল বহুরূপী। এ বার রোমান নাট্যকার সেনেকা অবলম্বনে অয়দিপস ফিরছেন কলকাতার মঞ্চে, ১১ সেপ্টেম্বর। নাটকের নাম ‘অয়দিপউস’। নাম ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার।
বহুরূপীর ‘অয়দিপাউস’-এর নাট্যরূপ ছিল শম্ভু মিত্রের নিজের। কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-কৃত সফোক্লেসের ইংরেজি অনুবাদটিই অনুসরণ করেছিলেন তিনি। তার পর অয়দিপসের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা এখানে আর হয়নি। এ বারের প্রযোজনার মূল ভিত্তি কবি টেড হিউগেসের করা ইংরেজি অনুবাদ। বাংলা রূপান্তর করেছেন হর ভট্টাচার্য।
অয়দিপসকে নিয়ে সফোক্লেসের নাটকটিই সব চেয়ে বেশি পরিচিত। এই নাটকের অভিনয় দেখেই উনিশ শতকের শেষে সিগমুন্ড ফ্রয়েড ‘অয়দিপস-এষণা’ তত্ত্বের কথা লেখেন। অয়দিপস সম্পর্কে তাঁর উক্তি ছিল, “অয়দিপসের নিয়তি আমাদের বিচলিত করে, কারণ এ ঘটনা আমাদের সঙ্গেও ঘটতে পারত যে দৈববাণী অয়দিপসের অভিশাপ বয়ে এনেছিল, সেই একই অভিশাপ জন্মের আগে থেকে আমাদের উপরেও বর্ষিত রয়েছে।” |
মহড়ায় দেবশঙ্কর। —নিজস্ব চিত্র |
এই ‘অভিশপ্ত’ জীবন-কাহিনি নিয়ে সফোক্লেসের আগে এবং পরেও কিন্তু একাধিক নাটক লেখা হয়েছে। সফোক্লেসের আগে গ্রিক নাট্যকার ইসকাইলাস (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫২৫/৫২৪-৪৫৬/৪৫৫) ক্রমান্বয়ে তিনটি নাটক লিখেছিলেন লাইয়ুস, অয়দিপস এবং সেভেন এগেনস্ট থিবস। প্রথম নাটক দু’টি পাওয়া যায় না। সফোক্লেস (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪৯৬-৪০৬) লেখেন রাজা অয়দিপস এবং অয়দিপস অ্যাট কলোনাস। তৃতীয় নাটকটি অয়দিপস-কন্যা আন্তিগোনেকে নিয়ে। ইউরিপিডিসের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪৮০-৪০৬) তিনটি নাটকে অয়দিপসের কাহিনি ঘুরেফিরে এসেছে ফিনিশিয়ান উইমেন, ক্রিসিপ্পাস ও অয়দিপস। এর প্রথম নাটকটিই পাওয়া যায় কেবল।
রোমে জুলিয়াস সিজার নিজে অয়দিপসকে নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও সেটি পরে আর পাওয়া যায়নি। রোমান দার্শনিক সেনেকা-র (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪ থেকে ৬৫ খ্রিস্টাব্দ) অয়দিপস তার সমসময়ে কোনও দিনই মঞ্চে অভিনীত হয়নি। নাটকটি মূলত পাঠ করা হত। এ নাটকের মঞ্চাভিনয় শুরু হয় রেনেসাঁসের যুগ থেকে। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে কবি ড্রাইডেন সেনেকা-প্রাণিত হয়েই অয়দিপস নামে ইংরেজি নাটকটি লেখেন।
ইতিহাসবিদেরা বলেন অয়দিপস ঐতিহাসিক নয়, পৌরাণিক চরিত্র। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, থিবসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফিনিশীয় রাজা ক্যাডমাস। অয়দিপসের পিতা লাইয়ুস সেই ক্যাডমাসেরই পৌত্র। ট্রয় যুদ্ধের এক প্রজন্ম আগের মানুষ। হেসিয়ড, পিনডার, হোমার, হেরোডোটাস সকলের রচনাতেই অয়দিপসের উল্লেখ আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক কুণাল চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, নাট্যকারেরা পুরাণ থেকে কাহিনিসারটুকু নিয়েছেন। তার পর তাকে নিজের মতো করে নির্মাণ করেছেন। যেমন হোমারে আছে, ইয়োকাস্তার সঙ্গে অয়দিপসের বিবাহের পরপরই দেবতারা জানিয়ে দেন, ইয়োকাস্তা অয়দিপসের মা। ইয়োকাস্তা আত্মঘাতী হন। অয়দিপসের দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সফোক্লেসের অয়দিপসের গল্প তার থেকে একেবারেই আলাদা। আবার সফোক্লেসের তিনটি নাটকের মধ্যেও একের সঙ্গে অন্যের কাহিনিগত ফারাক আছে। ইউরিপিডিসের নাটকে আবার দেখা গিয়েছে, অয়দিপস এবং ইয়োকাস্তা সব কিছুর পরেও একসঙ্গে থেকেছেন এবং সন্তানদের মধ্যে লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েছেন।
অনির্বাণ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় কলকাতা এ বার যে ‘অয়দিপউস’কে দেখতে চলেছে, তাতেও অনেকগুলো ‘নতুনত্ব’ রয়েছে। প্রথমত সফোক্লেসের সঙ্গে সেনেকার নাটকে এমনিতেই কয়েকটি পার্থক্য ছিল। যেমন, সফোক্লেসে আগে আত্মহত্যা করেন রানি ইয়োকাস্তা, তার পর নিজের দুই চোখ নষ্ট করে ফেলেন অয়দিপস। কিন্তু সেনেকায় আগে রাজা অন্ধ হন, তার পরে আত্মঘাতী হন ইয়োকাস্তা। সফোক্লেসে বলা আছে, শিশু অয়দিপসকে বধ করার জন্য মেষপালকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন রানি ইয়োকাস্তাই। সেনেকা এ ব্যাপারে নীরব।
এখানেই শেষ নয়। কিছুটা গ্রিক পুরাণ এবং কিছুটা নিজস্ব চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নাট্যকার হর ভট্টাচার্য এ বার কিছু মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন কাহিনিতে, যা সেনেকা বা সফোক্লেস কোথাওই নেই। এ নাটকে সন্তানকে বধ করার জন্য মেষপালকের হাতে তুলে দেয় রাজা লাইয়ুস, রানি ইয়োকাস্তা নয়। আর একটি সম্পূর্ণ নতুন মোচড় আসে ইয়োকাস্তার আত্মহত্যার দৃশ্যে। ইয়োকাস্তা এ নাটকে গলায় ফাঁস দিচ্ছেন না। বরং অয়দিপসের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নিজের চুলের কাঁটাটি ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যোনিতে। অনির্বাণ-হর-দেবশঙ্কর সকলেই এক বাক্যে বলছেন, বহুরূপীর প্রযোজনার সঙ্গে তুলনা না করে নতুন প্রযোজনাটিকে একটি আলাদা নাটক হিসেবে দেখাই ভাল।
কেন ‘অয়দিপউস’? অনির্বাণ বলেন, “ধ্রুপদী নাটক করার কথা ভাবছিলামই। রবীন্দ্রনাথ আর শেক্সপিয়র নিয়ে অনেকগুলো কাজ হচ্ছে বর্তমানে। তাই গ্রিক ট্র্যাজেডির কথা মনে এল।” গ্রিক ট্র্যাজেডি এর আগে সে ভাবে করা হয়নি দেবশঙ্করেরও। নান্দীকারে ‘আন্তিগোনে’-র রিহার্সাল দেখেছেন দিনের পর দিন। সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। এ বার অয়দিপস। “প্রথমে একটু ভয় যে করছিল না তা নয়। পুরনো রেকর্ডটা কানে বেজে উঠেছিল। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা যখন শুনলাম, তার পর থেকে একটা অদম্য আকর্ষণ চেপে বসল”, বললেন তিনি।
এ নাটকে অন্ধ অয়দিপসের সঙ্গে ইয়োকাস্তার একটি কথোপকথন আছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। স্ত্রীসত্তা আর মাতৃসত্তার দ্বন্দ্বে ধ্বস্ত ইয়োকাস্তা কী ভাবছিল তখন? ইয়োকাস্তার চরিত্রাভিনেত্রী সেঁজুতি মুখোপাধ্যায় বললেন, “ঠিক কী ভাবছিল, পুরোটা আন্দাজ করা সত্যি অসম্ভব। তবে অয়দিপস যখন নিজেকে অন্ধ করে দিয়ে তাকে স্ত্রী এবং মা দু’ভাবেই প্রত্যাখ্যান করল, তখন সে নিজেকে শেষ করে দেয়।” |
থিবসের রাজা লাইয়ুস দৈববাণী শুনেছিলেন, তাঁর ছেলে তাঁকে হত্যা করবে। শিশু অয়দিপসকে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। মেষপালক তা পালন করেনি। অয়দিপস বড় হলেন করিন্থে। দৈববাণী জানাল, তিনি বাবাকে হত্যা করে মাকে বিবাহ করবেন। অয়দিপস করিন্থ থেকে পালালেন। পথে অজান্তে লাইয়ুসকে হত্যা করলেন। রাজা হয়ে বিধবা রানি, নিজের মা, ইয়োকাস্তাকে বিবাহ করলেন। সত্য জানার পরে নিজেকে অন্ধ করে দেন অয়দিপস, আত্মঘাতী হন রানি। |