কোথাও নিকাশি নালায় জমে রয়েছে আবর্জনা। কোথাও আবার সুষ্ঠু নিকাশি না থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই জমে থাকে জল। তার উপর কচুরিপানায় নদীনালা ভরে গিয়ে স্বাভাবিক স্রোত ব্যাহত হওয়ায় তা মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। এর পাশাপাশি মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাবও রয়েছে। এই অবস্থায় কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গি ছড়ালেও কলকাতা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার চার পুরসভা হাবরা, অশোকনগর-কল্যাণগড়, গোবরডাঙা ও বনগাঁয় মশা দমনে পুর কর্তৃপক্ষের তৎপরতা এখনও সে ভাবে না দেখা যাওয়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বনগাঁ পুর কর্তৃপক্ষ অবস্য কিছু পদক্ষেপ নিলেও আজ, শনিবার থেকে তাঁরা মশা মারার অভিযানে নামবেন বলে হাবরা পুরকর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা ও গোবরডাঙা পুর এলাকাতেও এখনও সে ভাবে মশার বিরুদ্ধে পুরকর্তৃপক্ষ অভিযানে নামেনি বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। |
বনগাঁ পুর এলাকায় চলছে মশা দমন অভিযান। |
তৃণমূল পরিচালিত হাবরা পুরসভা এলাকায় যানজট মূল সমস্যা হলেও এখন তা ছাপিয়ে গিয়েছে মশার উপদ্রব। দিনে-রাতে মশার দাপটে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে বাসিন্দাদের বক্তব্য, বেহাল নিকাশির জন্যই এই অবস্থা। স্থানীয় নিকাশির প্রধান ভরসা পদ্মা খালের যত্রতত্র বুজিয়ে নির্মাণ কাজের জন্য তা নিকাশির ক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বৃষ্টিতে যত্রতত্র জল দাঁড়িয়ে গিয়ে মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত হচ্ছে। পাশপাশি তাঁদের অভিযোগ, যশোহর রোডের দু’ধারে থাকা নিকাসি নালাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। দিনের পর দিন সেখানে আবর্জনা জমে থাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা পবিত্র দেবনাথ জানালেন, “মশার উপদ্রব বাড়লেও পুরসভার পক্ষ থেকে মশা মারার জেল বা স্প্রে, ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর কাজ হচ্ছে না। হাবকরা পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের ঋজিনন্দন বিশ্বাসের অভিযোগ, ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া ঠেকানোর জন্য আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা যেমন মাইক প্রচার, নিকালি নালার সংস্কার, তেল ছড়ানো, স্প্রে কিছুই হচ্ছে না।” পুরকর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, নিকাশি নালাগুলি নিয়মিত সংস্কার করা হয়। এ ছাড়া, শনিবার থেকে পুরএলাকায় মশা মারার তেল স্প্রে, ব্লিচিং পাউডার ছাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে ডেঙ্গি প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেটও ছড়ানো হবে। যদিও ইতিমধ্যেই মাইক-প্রচার শুরু হয়েছে।
তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের বনগাঁ পুরসভা মলা মারার জন্য বাড়িতে বাড়িতে কীটনাশক তেল স্প্রে করার কাজ শুরু করেছে। পুরসভার জনস্বাস্থ্য বিভাগের চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল হিমাদ্রি মণ্ডল বলেন, “শুক্রবার থেকেই বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১০টি দল আলাদা আলাদ ভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারার তেল স্প্রে করার কাজ শুরু করেছে। সেই সঙ্গে পুরসভার যে মশা মারার কামান রয়েছে, সেটিও চালু করা হচ্ছে।” তবে বাসিন্দাদের বক্তব্য, শহরের নিকাশি নালাগুলি ঠিকমতো পরিস্কার করা হয় না। শহরের মধ্যে ২ নম্বর রেলগেট থেকে লাল পোল পর্যন্ত যে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ খাল রয়েছে, সংস্কারের অভাবে তা আবর্জনায় ভরে গিয়েছে। বালির ঘাট থেকে নতুন গ্রাম পর্যন্ত ইছামতী নদীর ধারে যে গার্ডওয়াল রয়েছে তার পাশে নোংরা জল জমে থাকে। |
বনগাঁয় ইছামতীর বর্তমান দশা। |
পুর এলাকার মধ্যে ইছামতী নদী কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মশার উপদ্রব মাত্রা ছাড়িয়েছে। অথচ এ সব দিকে প্রশাসনের কারও নজর নেই। পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলার স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেন, “মশা মারার তেল মাঝেমধ্যে দেওয়া হয়। তার উপর সর্বত্রই যে দেওয়া হয় তা বলা যাবে না। তার উপর মশা মারার জন্য যে কামান রয়েছে তাও অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।’’ পুরসভার চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আঢ্য বলেন, “বৃষ্টির জন্য দু’-একদিন বন্ধ থাকলেও পুরসভার পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারার তেল স্প্রে করা হচ্ছে। নিকাশি নালা, জঞ্জালও নিয়মিত সাফাই হচ্ছে। পাশাপাশি বাসিন্দাদের সদতর্ক করতে মাইকে প্রচারও শুরু করা হয়েছে।” পুরসভার চিকিৎসক সুকুমার সাউ বলেন, “স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কারও জ্বর হয়েছে কি না সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হচ্ছে।’’
মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়া নিয়ে পুরসভাকে দায়ী করেছেন রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন গোবরডাঙা পুরসভার বাসিন্দারাও। এখানেও সুষ্ঠু নিকাশির অভাবে জমা জল না সরা, রাস্তা থেকে আবর্জনা ঠিকমতো পরিষ্কার না হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, মশা মারার তেল স্প্রে করতে কখনও পুরকর্মীদের দেখা গেলেও তা সর্বত্র দেওয়া হচ্ছে কি না তা দেখার মতো নজরদারি নেই। নিয়মিত ছড়ানো হয় না ব্লিচিং পাউডার। পুর-চেয়ারম্যান সুভাষ দত্তর কথায়, “কলকাতা ও তার আশপাশে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ায় আমরা ইতিমধ্যেই পুর এলাকায় মশা মারার তেল স্প্রে করেছি। নিকাশি নালাও পরিষ্কার করা হয়েছে। মাইকে প্রচারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে।” |
জমা জলে মশার আঁতুড়ঘর। হাবরায়। |
মশা দমনে অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন বিধায়ক সত্যসেবী কর। তাঁর কথায়, “নিয়মিত নিকাশি নালাগুলি সংস্কার না হওয়ায় যত্রতত্র বৃষ্টির জল দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে জমা জলে মশা জন্মায়। মশা মারতে তেমন পুর উদ্যোগ কোথায়? যদিও পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান সমীর দত্তর দাবি, “পুর এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে মশা মারার তেল ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরাও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন।
তবে চারটি পুরসভার পক্ষ থেকেই মশা মারতে যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হলেও, তাঁদের মতে অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজা না হলে মশার উপদ্রব কমানো যাবে না। তবে, পুরসভাগুলির এ হেন দাবির সঙ্গে একমত নন বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের কথা বলে পুর কর্তৃপক্ষ আসলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন।
|
ছবি: পার্থসারথি নন্দী ও শান্তনু হালদার। |