এমন হবে জানলে বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা মুখে আনতেন না মিনতি। শুক্রবার রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বামীর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার এই আক্ষেপই করছিলেন ঝাড়গ্রামের চুবকা অঞ্চলের দেওয়ানচক গ্রামের সদ্য বিধবা তরুণী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাঁকুড়ার বারিকুল থানার অমৃতপুর গ্রামের কাছে ভৈরববাঁকি নদীর কজওয়েতে জলের তোড়ে বাস ভেসে যাওয়ার পরে যে আট জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছেন তাঁর স্বামী অজিত মুদিও (২৫)। স্ত্রী মিনতিকে নিয়ে রাইপুরের মণ্ডলকুলিতে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন খেতমজুর অজিত। নদীতে বাস ভেসে যাওয়ার সময় তিনি ছিটকে জলে পড়ে যান। শুক্রবার রাইপুরের একপাল ঘাট থেকে উদ্ধার হয় অজিতের দেহ। রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বামীর মৃতদেহ শনাক্ত করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিনতি। বলেন, “বাসের একটা সিটে আমি বসেছিলাম। ও দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ বাসটা মনে হল ভেসে গেল। পরে কিছু লোক আমাকে উদ্ধার করে। ওকে আর দেখতে পাইনি। এমন হবে জানলে বাসে চাপতাম না কখনও।”
বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনার পরে দু’জনের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। শুক্রবার রাইপুরের একপাল, আমবাড়ি, পাপড়পুর থেকে মোট পাঁচ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। ঝাড়গ্রামের অজিত ছাড়া বাকিরা হলেন বারিকুলের ফুলকুসমার বাসিন্দা মৃণালকান্তি সাহু (২৯), পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা সুমন্ত হালদার (২০), বেলপাহাড়ির ডড়রা গ্রামের জয়ন্তী শবর (২৪) ও হুগলির গোঘাটের বেঙ্গাইয়ের বাসিন্দা বিভাস প্রামাণিক (৩৪)। শুক্রবার লালগড়ের নছিপুর এলাকায় কংসাবতীতে ভেসে আসা বছর তিনেকের এক শিশুকন্যার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরিচয় অবশ্য জানা যায়নি। দেহটি মেদিনীপুর পুলিশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। |
বেলপাহাড়ি ব্লকের ন্যূনতম মজুরি পরিদর্শক বিভাসবাবু বেঙ্গাইয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে ওই বাসে চেপেছিলেন। শুক্রবার কলকাতায় একটি মামলায় তাঁর হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। তাঁর খোঁজে এ দিন সকালেই বারিকুল থানায় যান ভাই বিকাশ প্রামাণিক এবং বন্ধু মলয় ঘোষ। থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করার সময় তাঁরা খবর পান আরও দুই যুবকের দেহ উদ্ধার হয়েছে। এরপর রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে বিভাসবাবুর দেহ শনাক্ত করেন তাঁরা। মলয়বাবু বলেন, “ওই বাসেই বিভাস বাড়ি ফিরছিল। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ওর মোবাইলে ফোন করি। সাড়া না পেয়ে আজ নিজেরাই ঘটনাস্থলে আসি। এই দুঃসংবাদ বাড়ির লোকদের কী ভাবে জানাব, বুঝতে পারছি না।”
মৃত সুমন্ত হালদারের বাবা-মাকেও শোকসংবাদ জানিয়ে উঠতে পারেননি পরিজনেরা। বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রাম থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার জন্য বাসে চাপেন সুমন্ত। তিনি দুর্গাপুরে একটি দোকানে কাজ করতেন। তাঁর সম্পর্কিত কাকা রবীন্দ্র সিকদার বলেন, “সুমন্ত-র বাবা-মাকে এখনও জানানোই হয়নি। কী মুখে এই খবর দেব ভেবে পাচ্ছি না।”
জয়ন্তী শবরের শ্বশুরবাড়ি বেলপাহাড়ির ডড়রা গ্রামে। জয়ন্তীদেবীর স্বামী পেশায় দিনমজুর লাল্টু শবর জানান, নয় মাসের মেয়ে শিলাকে নিয়ে জয়ন্তী বাঁকুড়ার রাইপুরের হাঁসডোবা গ্রামে বাপের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। মায়ের নিথর দেহ উদ্ধার হলেও শিশুকন্যার হদিস মেলেনি।
শিলদা থেকে দিদিমার সঙ্গে অভিশপ্ত বাসটিতে উঠেছিল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বছর ন’য়েকের জিৎ গড়াই। বৃহস্পতিবারই জিতের দেহ উদ্ধার হয়। দিদিমা শিবানী মণ্ডল অবশ্য প্রাণে বাঁচেন। শুক্রবার বিনপুরের কামারবান্ধি গ্রামের বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিবানীদেবী বলেন, “বৃহস্পতিবার নাতিকে নিয়ে বাঁকুড়ার মঠগোদায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। সব শেষ হয়ে গেল। এমন বেঁচে থেকেও বা কী লাভ!” বৃহস্পতিবারই দেহ উদ্ধার হয়েছিল সোমনাথ দত্তের (৩২)। তাঁর কাকু সমীর দত্ত জানান, দুই বন্ধুর সঙ্গে ফুলকুসমা থেকে রাইপুর যাচ্ছিলেন সোমনাথ। স্রোত দেখে প্রথমে বাস থেকে নেমেও গিয়েছিলেন তাঁরা। ঝুঁকি নিয়ে ফের বাসে ওঠাটাই ‘কাল’ হল।
রাজ্যের শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায় দুর্ঘটনাস্থলে যান এ দিন। রাইপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে মৃতের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন শ্যামবাবু। তিনি বলেন, “সরকারি নিয়ম মেনেই মৃত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।” |